চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচারকারীদের তৎপরতা থামছে না। পাচারকারীরা নানা কায়দায় মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দুবাই থেকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা চ্যানেল পেরিয়ে স্বর্ণের চালানগুলো তাদের গোপন গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেল কয়েক বছরে ধরা পড়েছে অনেকগুলো চালান। তবে পাচারকারীদের চালানের কি পরিমান ধরা পড়ছে, আর কি পরিমান পাচারকারীরা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা চ্যানেল ফাঁকি দিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারছে, সে ব্যাপারে নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) আবারও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়ল প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকার স্বর্ণ।
জানা যায়, এদিন সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে দুবাই থেকে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের একটি সিটের নিচে লুকানো ২০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়েছে। যার ওজন ২ কেজি ৩০০ গ্রাম, বাজার মূল্য ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এনএসআই চট্টগ্রাম বিমানবন্দর টিম, বিমানবন্দর নিরাপত্তা শাখা এবং শুল্ক গোয়েন্দা যৌথভাবে এ অভিযান চালায়।
শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল জানান, দুবাই থেকে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-১৪৮ ফ্লাইটের ভেতর তল্লাশির মাধ্যমে এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে।
স্বর্ণগুলো বিমানের ৯-জে সিটের নিচে প্লাস্টিক টেপ দিয়ে মুড়িয়ে বিশেষ কায়দায় লুকানো ছিল।
উদ্ধার করা স্বর্ণ বিমানবন্দর শুল্ক গোয়েন্দার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বর্ণগুলো চোরাচালানের উদ্দেশ্যে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে আনায় এগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।
তিনি জানান, তদন্তের স্বার্থে আটক যাত্রীর পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা মডেল থানায় ফৌজদারী মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সূত্র বলছে, আর্থিক সচ্ছলতার আশায় লোভের বষিভূত হয়ে অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাত কিংবা দুবাই গিয়ে নিজ পেশা ছেড়ে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছে।
সূত্র মতে, বিমান বন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে চোরাচালানের স্বর্ণ বাহকরা মাঝেমধ্যে ধরা পড়লেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে আর্ন্তজাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ২০টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশে স্বর্ণের চালান আসে। এর মধ্যে ৫-৬টি বিদেশী সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের মধ্যে বেশ কয়েকটি সরাসরি আর কিছু মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে। দেশী সিন্ডিকেটের মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরেই রয়েছে বেশ কয়েকটি। বাকি কয়েকটির মধ্যে দুইটি চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ও একটি রয়েছে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর ঘিরে।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার মতে, ধরা পড়া স্বর্ণ উদ্ধারের মূল কারণ যতটা না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কৃতিত্ব; তার চেয়েও বেশি সিন্ডিকেট সদস্যদের অন্তদ্বন্ধ। নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হওয়া, উৎকোচ কমবেশি হওয়া, ভাগবাটোয়ারায় কমবেশি হওয়া, সমঝোতার অভাব, তৃতীয় মাধ্যম হয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের তথ্য ফাঁস হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সদস্যদের অন্তদ্বন্ধের কারণে মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরে চোরাচালানের স্বর্ণ আটক করা সম্ভব হলেও বিশাল অংশ থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সূত্র জানায়, এদের অধিকাংশই স্বর্ণ চোরাকারবারি সিন্ডিকেট। ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনতে এই সিন্ডিকেট কয়েকটি ভাগে কাজ করে। দেশে আসার সময় প্রবাসীরা ক্যারিয়ার গ্রুপ হিসেবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে স্বর্ণ বহন করে। অথবা সিন্ডিকেট প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার তুলনামূলক বেশি দামে কিনে নিয়ে ওই দেশেই স্বর্ণের দেনা পরিশোধ করে এবং বাড়তি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণ নিয়ে দেশে ফিরতে উৎসাহিত করছে।
বর্তমানে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের প্রধান টার্গেট আরব আমিরাত ও দুবাই থেকে আসা যাত্রীরা। এ কাজে উৎসাহিত করতে নানা প্রলোভন দেওয়া হয়। কখনো বিমান টিকিট, কখনো কমিশন, আবার কখনো বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যের চেয়ে বাড়তি টাকা দেওয়া হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত। এ কারণে হোতাদের চেয়ে স্বর্ণ বহনকারীরাই আটক হচ্ছে বেশি। স্বর্ণ কার কাছ থেকে এসেছে, কোথায় যাবে বা কার কাছে যাবে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানে না বাহকরা।
ফলে তাদের আটকের পর কারা চোরাচালানের পেছনে রয়েছে তা শনাক্ত করা বেশ কঠিন। অনেক ক্ষেত্রেই তা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ প্রসঙ্গে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল দৈনিক বায়ান্নকে বলেন, আমরা যথেষ্ট সতর্ক আছি। আমাদের নিরাপত্তা বলয় বাড়ানোর কারণেই চালানগুলি আমরা ধরতে সক্ষম হচ্ছি।
বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএইচ