ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

সরকারবিরোধী বক্তব্যেই মকবুলের পতন!

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : বুধবার ১৯ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৪৮:০০ পূর্বাহ্ন | এক্সক্লুসিভ

 

সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মো. মকবুল হোসেনকে নিয়ে এখানো আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। আকস্মিক এই অবসরের নেপথ্যের কাহিনী নিয়ে চলছে নানামুখী জল্পনা-কল্পনা। মুখরোচক অনেক কথাও ছড়িয়েছে নানাভাবে।

 

কিন্তু আসলে কী কারণে মেয়াদ পূর্তির এক বছর আগেই তথ্য ও সম্প্রচার সচিবকে সরকার আকস্মিকভাবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালো। তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে অনেক তথ্য।

 

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে অন্তত পাঁচটি কারণে সরকার তথ্য সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে সরকার।

 

বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে যেসব তথ্য পেয়েছে তাতে সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর অন্যতম কারণ হচ্ছে-সম্প্রতি সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক সভায় মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া সচিবের একটি বক্তব্য। যা সরাসরি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

এ ছাড়া, আগামী বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা সম্প্রচার নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বড় অঙ্কের একটা চুক্তির প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করা, মন্ত্রণালয়ের সবকাজে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করা, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ফিল্ম আর্কাইভসহ তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন প্রতিষ্ঠানের নথি দিনের পর দিন আটকে রাখা, পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে অধিক আগ্রহসহ আরও অনেকগুলো কারণে সরকারের খড়গ নামে তথ্য ও সম্প্রচার সচিবের উপর। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সচিবের সরকার বিরোধী বক্তব্যই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

একাধিক সূত্র জানায়, গত ৪ অক্টোবর সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মো. মকবুল হোসেন। সেখানে মন্ত্রী অনুপস্থিত ছিলেন।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত চার জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা  বলেন, ওই সভায় সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো সচিব মকবুল হোসেন সরকারের সমালোচনা করে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে কড়া ভাষায় নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। সেখানে মকবুল হোসেন বলেন,‘আমরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আমরা কোনো দলের কর্মচারী না। সরকার আসবে সরকার যাবে, আমরা আমাদের মত কাজ করব। আমরা কারো কথা মত কাজ করব না।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘আমলাতন্ত্র এখনো মরে যায়নি। আমলাতন্ত্র এখনো আছে। আপনারা সবাই আমলাতন্ত্রের কথা মত কাজ করবেন।’

 

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সচিবের এই বক্তব্য সভায় উপস্থিত অনেকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলেননি।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়ার পেছনে তার এই বক্তব্য মূখ্য ভূমিকা রেখেছে। সরকারের শেষ সময়ে এসে সচিবের এমন বক্তব্য কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান বলে করছেন তারা।

 

বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এই সচিবের বিরুদ্ধে আরও অনেকগুলো অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর অগোচরে। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একক ভূমিকা রেখেছেন। যা মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে এক ধরনের শীতল সম্পর্ক তৈরি করে।

 

সূত্র জানায়, মকবুল হোসেন গত কয়েক মাসে নিজেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সর্বেসর্বা হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেছেন। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।

 

একজন কর্মকর্তা জানান, সচিব বেতার, টেলিভিশন, ফিল্ম আর্কাইভসহ প্রায় সব দপ্তরের গুরুত্ত্বপূর্ণ নথি দিনের পর দিন কোনো কারণ ছাড়াই আটকে রাখতেন। এতে মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরগুলোতে কাজের গতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ রেখে সচিব মকবুল হোসেন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের পদোন্নতি দিতেই বেশি আগ্রহ দেখাতেন। কেউ কেউ বলছেন, এতে তার ইন্টারেস্ট আছে।

 

এসব কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখানোর ঘটনা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়,বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো সচিব মকবুল হোসেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে পাশ কাটিয়ে একাই একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিটিভিতে খেলা সম্প্রচারের বিষয়ে এমওইউ স্বাক্ষর করেছেন।

 

শুধু তাই নয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে থেকে টাকা ছাড় করার বিষয়ে একজন সিনিয়র সচিবের শরণাপন্ন তথ্য সচিব। এই ঘটনা এবং মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এডিপি সভায় দেওয়া বক্তব্য সচিবের বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তকে তরান্বিত করে।

 

সূত্র জানায়, ফিফা বিশ্বকাপ বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর সঙ্গে প্রায় ছয় মাস আগে কথা বলেন তথ্য সচিব মকবুল হোসেন। মন্ত্রী তাতে সায় দেন। কিন্তু মন্ত্রীর সায় পাওয়ার পর এ বিষয়ে সচিব এককভাবেই সব সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টি সম্পর্কে মন্ত্রীকে আর কোনো কিছু জানানোর প্রয়োজন অনুভব করেননি।

 

সূত্র জানায়, ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা সম্প্রচারের স্বত্ত্ব ফিফা থেকে কিনে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান ভায়াকম। তারা সেটি বিক্রি করে সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এভামোর এর কাছে। সেখান থেকে সম্প্রচার স্বত্ত্ব ক্রয় করে বাংলাদেশের এনডব্লিউও-কে স্পোর্টস।

 

তথ্যসচিব মকবুল হোসেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অন্তত দুই জন প্রভাবশালী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে ১০৪ কোটি টাকায় খেলা সম্প্রচারের জন্য তমা নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেন। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি সচিব সম্পন্ন করেন তথ্যমন্ত্রীকে অন্ধাকারে রেখে। অবশ্য মন্ত্রী জানার পর সেটি আর সামনে এগোয়নি।

 

এ ছাড়া, মকবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি যখন চট্টগ্রামে পরিবেশ অধিদপ্তরে ছিলেন তখনো তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠে। সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর অধ্যাপক ইদ্রস আলী নামে চট্টগ্রামের এক পরিবেশকর্মী তার ফেসবুক ওয়ালে সেই ঘটনা তুলে ধরেন।

 

এর বাইরে মকবুল হোসেনর বিরুদ্ধে আগেই একাধিক বিভাগীয় মামলা হয়েছিল অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য। এত কিছুর পরও তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গত বছরের ৩১ মে।

 

১৬ অক্টোবর (সোমবার) দুপুরের পর মকবুল হোসেন যখন নিজ দপ্তরে কাজ করছিলেন ঠিক তখনই তার বাধ্যতামূলক অবসরের প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তার চাকরির মেয়াদ আরও এক বছর বাকি থাকতেই তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কারণে বিভিন্ন মহলে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়।

 

অবশ্য ১৭ অক্টোবর দুপুরের পর সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে গিয়েছিলেন সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মকবুল হোসেন। এ সময় সাংবাদিকরা তাকে অবসর দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তিনি এও দাবি করেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে কখনো অনৈতিক কাজ করেননি। কোনো রকম আর্থিক অনিয়মের সঙ্গেও তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।