টিকটকে পারদর্শী, অল্প বয়সী, সুন্দরী ও স্বল্প শিক্ষিত মেয়েদের টার্গেট করতো একটি মানবপাচারকারী চক্র। এরপর তাদের দুবাই ড্যান্স ক্লাবে মাসে এক লাখ ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরির কথা বলে পাচার করা হতো। কোনো টাকা ছাড়াই বিদেশ যাওয়ার এমন প্রলোভন দেখিয়ে চক্রটি এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক নারীকে দুবাইয়ে পাচার করেছে।
সম্প্রতি এমন প্রলোভনে দুবাই পাচার হতে যাওয়া ১৮ বছর বয়সী এক নারীকে বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। পুরুষদের বিদেশে পাঠানোর জন্য দালাল চক্রটি তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিলেও নারীদের পাঠাতে কোনো টাকা নিতো না। উল্টো মেয়েদের টাকা দেওয়া হতো।
র্যাব বলছে, পাচারকারীরা বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল তরুণী ও পুরুষদের ফাঁদে ফেলে দুবাইয়ে নিয়ে যেত। তাদের পাতা জালে জড়িয়ে অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে সাধারণ বহু মানুষ। যাদের অধিকাংশই নারী। এসব নারীকে বিদেশে বিভিন্ন পেশায় লোভনীয় ও আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির কথা বলে তারা বিক্রি করে দিতো। পরে জোর করে জড়ানো হতো ডিজে পার্টি, যৌনতাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।
এলিট ফোর্সটি আরও বলছে, পাচারকারী চক্র অতি কৌশলে নারীদের বিভিন্ন মাধ্যমে ঢাকায় এনে হোটেলে রেখে পাসপোর্ট এবং দক্ষ কর্মী হিসেবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কার্ড করে দিতো। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে বিএমইটি কার্ড তৈরি করতে সময় লাগে এক মাস। কিন্তু কোনো ট্রেনিং ছাড়াই বিএমইটি কার্ড দেয় চক্রটি, পরবর্তীসময়ে সেটি হারিয়ে গেলে আবারও কার্ডের ব্যবস্থা করে তারা। পাচারকারী চক্র অতি কৌশলে নকল এই বিএমইটি কার্ড তৈরি করে নারীদের পাচার করে। পাচার করতে যাওয়া একজন নারীকে দেশে থাকা অবস্থায় ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম দেয় চক্রটি। এভাবে চক্রটি প্রায় শতাধিক নারীকে দুবাইয়ে পাচার করেছে।
র্যাবের একটি সূত্র জানায়, এই পাচারচক্রের মূলহোতা মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন বর্তমানে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। তার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে চক্রের অন্য সদস্যরা কাজ করেন। জিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কোম্পানি ও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ ড্যান্স ক্লাবে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এই প্রতারক চক্র নারীদের বিদেশে যেতে প্রলুব্ধ করে।
তিনি বলেন, কাগজপত্র সবকিছু কমপ্লিট করে বিমানবন্দরে যাই। প্রথমবার কাগজপত্রে কিছু ভুল থাকায় ফিরে আসি। দ্বিতীয়বার বিমানবন্দরে গেলে ভুল থাকায় যাওয়া হয় না। তৃতীয়বারও ভুল ছিল। এরপর চতুর্থবার যখন যেতে চাই তখন র্যাবের সদস্যরা আমাকে যেতে বাধা দেয় এবং আমাকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে আনে।
‘এরপর থেকে চক্রটি আমাকে বলে- আমার পেছনে যে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তা ফেরত দিতে। যদি না দেই তাহলে আমার সমস্যা হবে বলে জানায় তারা। আমি তাদের বলি, ধীরে ধীরে আপনাদের টাকা আমি ফেরত দিয়ে দেবো আমাকে কিছুদিন সময় দিন।’
শুধু নারীরাই নয় চক্রটি পুরুষদেরও টার্গেট করতো। নারীদের বিনামূল্যে পাসপোর্ট-ভিসা করে দিলেও পুরুষদের থেকে নেওয়া হতো তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা।
এমনই একজন ভুক্তভোগী যশোরের ঝিকরগাছার মো. জসিম। তিনি বলেন, লেবার ভিসায় সৌদি আরব যাওয়ার জন্য আমার পাশের এলাকার সাইফুল নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। বিদেশফেরত সাইফুল লোকজনদের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। সে কারণেই তার দ্বারস্থ হই। পরে সাইফুলের মাধ্যমে শহিদুল নামে আরেক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। লেবার ভিসায় সৌদি আরব নিয়ে যাবে বলে চার লাখ টাকা ঠিক হয়। সাইফুল ও শহিদুলের কথামতো তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা তাদের হাতে তুলে দেই।
জোগাড় করা টাকার পুরোটাই লোকজনদের কাছ থেকে সুদে আনা হয়েছে উল্লেখ করে জসিম বলেন, এত টাকা কীভাবে ফেরত দেবো? বাড়ি গেলেই তো টাকার জন্য আসবেন পাওনাদাররা। আমি তো এখন এত টাকা ফেরত দিতে পারবো না। কী করবো মাথায় ঢুকছে না। যদি বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়, তাহলে তিন মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবো জানি না।
জসিম আরও বলেন, একমাস ধরে উত্তরার একটি হোটেলে আমাদের কয়েকজনকে রাখা হয়। সাইফুল-শহিদুল প্রায় প্রতিদিনই বলতো কয়েকদিনের মধ্যেই টিকিট করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তারা বলেছিল জিয়াউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি আমাদের ভিসা করিয়ে দিয়েছে। তিনি সব ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এখন আমরা প্রতারণার শিকার। আমি এখন নিঃস্ব।
শুধু জসিম নয়, এই চক্রের খপ্পরে পড়েছেন কালীগঞ্জের শফিয়ার রহমানও। তিনি বলেন, এক পরিচিত ভাইয়ের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার জন্য সাইফুলের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাদের গ্রামে সাইফুলের ভায়রা সোহাগ থাকতো। তার মাধ্যমেই যোগাযোগ। সাইফুলের কথামতো বিদেশ যাওয়ার জন্য চার লাখ টাকা জোগাড় করি। টাকাটা আশা সমিতি (এনজিও) থেকে নিয়েছিলাম। সব হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবো, মাথায় আসছে না।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, টিকটক করতে পারে, অল্প বয়সী ও যাদের নাচের প্রতি আগ্রহ রয়েছে এমন নারীদের টার্গেট করা হতো। এরপর উচ্চ বেতনে দুবাইয়ে ড্যান্স ক্লাবে চাকরির কথা বলে তাদের পাচার করা হতো। বিদেশ পাঠাতে মেয়েদের কাছ থেকে কোনো টাকাও নেওয়া হতো না। তাদের ড্যান্স ক্লাবে চাকরির কথা বললেও ভিসার সঙ্গে কাগজপত্রে মেশিন অপারেটরের কাগজপত্র তৈরি করে দিতো। কারণ ড্যান্স ক্লাবে মেয়েদের কোনো নিয়োগ হয় না।
তিনি বলেন, চক্রটির বিরুদ্ধে আরও বেশকিছু তথ্য পেয়েছি আমরা। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যারা করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়, ভুয়া ভিসা দেয় তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। পাসপোর্ট থেকে ভিসা প্রসেসিং, ওয়ার্ক পারমিট, বিএমইটি কার্ডসহ সবকিছু চক্রের সদস্যরা করে দিতো।
‘জিয়াউদ্দিন বিভিন্ন স্তরে লোক ঠিক করে রাখতেন। বিএমইটি কার্ড করার জন্য ছিল একটি গ্রুপ, মেয়েদের হোটেলে রাখার জন্য একটি গ্রুপ, ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য একটি গ্রুপ, ভিসা মূলত জিয়া হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতেন। এরপর একটি গ্রুপ তা প্রিন্ট করে বিমানবন্দরে যেত। আর দুবাই গমনেচ্ছুদের বিমানবন্দরে নিয়ে আসার জন্য ছিল আরেকটি গ্রুপ।’
দেশের বাইরে থাকা চক্রের মূলহোতা মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, জিয়াউদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কাজ চলছে। আশা করছি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।