ঢাকা, মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সিলেটি মা: মায়ের চোখের পানি বিচলিত করত

এমএ রহিম, সিলেট: | প্রকাশের সময় : বুধবার ১৩ মার্চ ২০২৪ ০৩:২১:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী। সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নূরপুর গ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত। এখন তিনি সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি। শৈশব থেকে গর্ভধারিণী মায়ের আদর্শ লালন করে আসছেন। ২০০৮ সালে ইন্তেকাল হওয়া মায়ের উপদেশ পালন করছেন  আজো। মায়ের ইচ্ছাকে সামনে রেখে এগিয়ে গেছেন তিনি। মা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। মায়ের কথা বলতেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি।

কাইয়ুম চৌধুরী জানান, ‘মমতাময়ী মা সামাদুন নেছা খাতুন চৌধুরী ছিলেন একজন শিক্ষক। ২০০৮ সালে ২৫ ফেব্রæয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। বাবা মাওলানা আবদুল মান্নান চৌধুরী ইন্তেকাল করেন ১৯৮৪ সালে। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী সর্বকনিষ্ঠ। বড় বোন রফিকুন নাহার চৌধুরী বেঁচে নেই। মেজো বোন সহিদুন নাহার চৌধুরী সিলেট শহরে স্বামী সংসারে বসবাস করেন। স্বামী বেঁচে নেই। ছোটে বোন আবিদা সুলতানা চৌধুরী যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৬৬ সালে।’

তিনি জানান, ‘একটু বুঝতে শেখার পর আমি জানতে পারি মা একজন শিক্ষিকা। ওই এলাকার শিক্ষা বিস্তারে মায়ের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। সে সময় ওই এলাকায় নারী শিক্ষার তেমন একটা প্রচলন ছিল না। এলাকায় নারী শিক্ষা বিস্তারে দাদা প্রতিষ্ঠা করেন স্কুল। ওই স্কুলে মা ভর্তি হয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। তখন ছিল বৃটিশ আমল। ওই বৃটিশ আমলেই মা এন্ট্রেন্স পাস করেন। পরে কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে। মা শিক্ষক হওয়ায় তার একটি বিশাল প্রভাব পড়েছে আমার জীবনে।’

কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘মায়ের কাছেই শিক্ষা জীবনের বিদ্যাচর্চা শুরু হয়েছে। আরবি হরফ বা অক্ষর মায়ের কাছে শিখেছি। বাংলা ও ইংরেজির বেলায়ও একই অবস্থা। মনে আছে সকাল আর সন্ধ্যায় নিয়ম করে মা আরবি, বাংলা ও ইংরেজি শেখাতেন। আরবির সকল ধরণের দোয়া কালাম শিখিয়েছেন মা। মায়ের কাছে শিখেছি কুরআন পড়া। নামাজও শিখেছি মায়ের কাছে। জায়নামাজে দাঁড় করিয়ে শিখিয়েছেন নামাজ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের যাবতীয় নিয়ম কানুন শিখিয়েছেন মা। এক সময় নিজ ইচ্ছায় গ্রামের মসজিদের মক্তবে যেতাম। মক্তবে কুরআন পড়া শেষ করেছি। সেখানে পড়তে শিখেছি ঈদের নামাজ, জানাজার নামাজ ও জুমআর নামাজ। ধর্মপ্রাণ ও পরহেজগার মা চাইতেন ধর্মের প্রতিটি ধাপ যেন নিখুঁতভাবে শিখি। মায়ের ওই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। বাংলা ও ইংরেজি শিখিয়েছেন যতœসহকারে। যেহেতু মা একজন শিক্ষক ছিলেন। এই অবস্থায় মায়ের পাঠদানের মধ্য দিয়ে আমার শিক্ষাজীবন এগিয়ে যেতে থাকে। মায়ের আদর আর শাসনের মধ্য দিয়ে বাড়িতেই ১৯৭২ সাল পর্যন্ত লেখা পড়া করেছি। ১৯৭২ সালে স্থানীয় দরগাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই ২য় শ্রেণিতে। শুরু হয় স্কুল জীবনের।’

তিনি বলেন, ‘কঠোর শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন হওয়ার পর চোখে চোখে রাখতেন মা। মায়ের আদেশ কোনোদিন লঙ্ঘন করিনি। লঙ্ঘন করার সাহসও পেতাম না। মা সাত সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন। ফজর নামাজ পড়ে শুরু করতেন দিনের কাজ। আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতেন। বাধ্য করতেন নামাজ পড়তে। এক সময় নিজ থেকেই নামাজ পড়তাম। নামাজ শেষে আরবি পড়তাম। মা নাস্তা তৈরি করতেন। নাস্তা শেষে স্কুলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত করতেন। মাও প্রস্তুতি নিতেন নিজ কর্মস্থল স্কুলে যাওয়ার জন্যে। আমার ও মায়ের স্কুল ছিল পৃথক। অনেকদিন এক সাথে ঘর থেকে বের হতাম। আবার কোনো কোনোদিন মা চলে যেতেন আগে। পরে যেতাম আমি। স্কুলে যাওয়ার সময় মা প্রতিদিনই উপদেশ দিতেন। কারো সাথে অন্যায় করা যাবে না, ঝগড়া করা যাবে না। সকলের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে। মায়ের এসব উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতাম প্রায় একই সময়ে। মা বাড়ি ফিরে সংসারের কাজে নিজকে নিয়োজিত করতেন। আমি বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া শেষে স্থানীয় খেলার মাঠে ছুটে যেতাম। সেখানে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, হাড ডু ডুসহ নানান ধরণের খেলায় অংশ নিতাম। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হতো। এ ব্যাপারে মায়ের কঠোর নির্দেশনা ছিল। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। একটু দেরি হলে উপযুক্ত কারণ দর্শাতে হতো। অন্যথায় কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতো। সন্ধ্যার পর পড়ার টেবিলে। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে মা ছিলেন কঠোর। কঠিন শাসনের পাশপাশি আদর যতœ দিয়ে লেখা পড়ায় মনোযোগী করে তুলেছিলেন শৈশব থেকে।  রাত ১০ টার মধ্যে খাওয়া দাওয়া ও লেখাপড়া শেষে শয়ন কক্ষে যেতে হতো। সেসময় বিদ্যুত ছিল না। তাই হারিকেনের আলোতে লেখা পড়া করতে হতো। ঘুমিয়েছি কি না তা নিয়মিত পরোখ করতেন মা। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতেন। সব কাজ শেষে ঘুমাতে যেতেন মা। অনেক দিন দেখেছি গভীর রাতে তাহাজুদের নামাজ পড়ছেন মা। সাতসকালে আবার ঘুম থেকে উঠে ফজর নামাজ পড়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘মায়ের কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে জানান দিতেন আমাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কারণ এই পরিবারের অনেকেই এক সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। একই পথে আমাকেও যেতে হবে। কিন্তু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ি। বিষয়টি মায়ের কাছে গোপন থেকে যায়। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঢাকায় বসবাসরত বড় বোন রফিকুন নাহার চৌধুরী আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। আমার যাতে লেখা পড়া চালিয়ে যেতে কোনো ধরণের সমস্যা না হয়-সেদিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখতেন মা। প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতেন।’  

তিনি বলেন, ‘শিক্ষাজীবন শেষে আমি কি করব-তা নিয়ে মায়ের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। মায়ের ইচ্ছে ছিল আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করা। বিদেশমুখি যাতে না হই-সেদিকে ছিল মায়ের নির্দেশনা। বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে আমার ভেতরে অনিহা সৃষ্টি করেছিলেন। যেহেতু মায়ের কোনো ইচ্ছে ছিল না-তাই আমি রাজনীতিতে যুক্ত হই। বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর চিন্তিত হয়ে উঠেন মা। ওই অবস্থায় মা সব সময় নির্দেশনা দিতেন সঠিক পথে থাকার জন্যে। মায়ের নির্দেশনা ও দোয়া নিয়ে এগিয়ে চলেছি আমি।’

আবদুল কাইয়ুম জানান, ‘ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ১৯৮১ সালে ছাত্রদলের রাজনীতি দিয়ে রাজনীতি শুরু করি। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কেন্দ্রীয় যুবদলের সহসভাপতিও ছিলেন। বর্তমানে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছি। বিএনপির সরকারের সময় এম সাইফুর রহমান ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী। অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেছি। ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ছিলাম। ছিলাম ক্রিকেট অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান। বিএনপির সময় এসব দায়িত্ব পালন করার সময় জনসেবায় নিজকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ হয়। এতে খুশি হয়ে উঠেন মা। মানবকল্যাণের প্রতিটি কাজের খুশি হয়ে দুই হাত তুলে মহান আল্লাহর দরবারে আমার জন্যে দোয়া করতেন মা। একমাত্র পুত্র সন্তান হিসেবে আমার সুন্দর প্রতিষ্ঠা কামনা করতেন মা।’

কাইয়ুম চৌধুরী বলেন,‘এরশাদ সরকারের আমলে একবার কারাগারে যেতে হয়োিছল। সর্বশেষ ২০১১ সালে কারাগারে যেতে হয়। এরশাদ সরকারের আমলে কারাগারে যাওয়ার বিষয়টি মা প্রথমে জানতে পারেননি। পরে জানতে পেরে শঙ্কিত হয়ে উঠেন। এর পর থেকে যখনই বাড়িতে আসতাম-ফেরার সময় ট্রেনে করে যেতাম। বিদায় জানানোর সময় জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতেন মা। চোখের পানিতে সার্ট ভিজে যেত। মায়ের কাছে দোয়া চেয়ে রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতাম।’

তিনি বলেন, ‘মায়ের নামাজ পড়ার জন্যে পৃথক একটি কক্ষ ছিল। শৈশবে ওই কক্ষে মায়ের জায়নামাজে শুয়ে পড়তাম। মা আমাকে না সরিয়ে নামাজ পড়তেন। নামজ শেষে দুই হাত তুলে দোয়া করতেন। তখন দেখেছি মায়ের চোখের পানি। এছাড়া ঢাকা থেকে যখনই বাড়ি যেতাম, তখন সময় মত মায়ের নামাজ পড়ার ওই কক্ষে যেতাম। মা যখন নামাজ পড়া শুরু করতেন, তখন আমি ওই কক্ষে গিয়ে বসে থাকতাম। দেখেছি নামাজ শেষে মা দুই হাত তুলে কাঁদছেন, আর চোখের পানি ফেলছেন। সুযোগ পেলেই ওইভাবে মায়ের দোয়া আদায় করে নিতাম। পৃথীবিতে আমার আবেগর  সর্বোচ্চ স্থান হচ্ছে আমার মা। ১৯৯৭ সালে মাকে নিয়ে হজ¦ করেছি। এটা আমার জীবনের পরম তৃপ্তি।’

তিনি বলেন, ‘আমার মা ছিলেন অত্যন্ত পরোপকারী, মানবিক ও দয়ালু। কেউ বিপদে পড়ে মায়ের কাছে এলে-সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। কেউ হাত বাড়ালে খালি হাতে ফেরাতেন না। আমাদের বাড়িতে নানান ধরণের ফসল ফলত। এসব ফসলের বিশাল একটা অংশ পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে বিতরণ করতেন। কাউকে কিছু দিতে পারলে অনেক খুশি হতেন মা। অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে হাসতেন মা।’


কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘শেষ জীবনে ঢাকায় আমার সাথে থাকতেন মা। সুস্থই ছিলেন। তেমন একটা অসুস্থ দেখিনি কোনোদিন। ২০০৮ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। বাসার কাছেই ছিল এপোলো হাসপাতালে। আমার দুই হাতের উপর রেখে মাকে নিয়ে যাই হাসপাাতালে। ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। জানালেন-মা বেঁচে নেই। চোখে অন্ধকার দেখলাম। আমার মনে হয়েছে আমার হাতের উপরই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন মা। মায়ের দোয়া থেকে বঞ্চিত হলাম সারাজীবনের জন্যে। মায়ের হাত আর উঠে আসবে না আমার মাথায়।’