ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১

স্বাধীনতার অর্ধশতক পার হলেও অবহেলায় ঠাকুরগাঁওয়ের বধ্যভূমিগুলো

রবিউল এহ্সান রিপন: | প্রকাশের সময় : বুধবার ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:১০:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর


 মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাস সারাদেশে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তখন ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষও রক্ষা পায়নি। ‘৭১’র সময়কার দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত ঠাকুরগাঁও মহকুমা যা বর্তমানে জেলা সেখানে মুক্তিযুদ্ধে নৃশংস গণহত্যার শিকার বীর শহীদদের গণকবর তথা বধ্যভূমিগুলো এখনও প্রাপ্য মর্যাদায় রক্ষিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার নিরব সাক্ষী এসব বধ্যভূমি সংস্কারের অভাবে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। তবে দু’একটি গণকবরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে সেগুলো সুরক্ষার ব্যবস্থা হলেও অধিকাংশই পড়ে আছে অযতœ অবহেলায়।

অধিকাংশ বধ্যভূমি ময়লা-আবর্জনার স্তুপে ঢাকা, নেই যাতায়াতের রাস্তা। নির্দিষ্ট দুই-একটি দিন ছাড়া সারাবছরই বধ্যভূমিগুলো মাদকসেবীদের দখলে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পৃক্ততার অভাবে অনেকেই বধ্যভূমিগুলোর ইতিহাসই জানেন না। এছাড়া নামফলক ও যুদ্ধে স্থানীয় শহীদদের নামও উল্লেখ নেই বেশিরভাগ বধ্যভূমিতে।

সম্প্রতি জেলার ৫টি উপজেলায় ঘুরে দেখা যায়, সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা বধ্যভূমি, রাণীশংকৈল উপজেলার খুনিয়াদিঘী বধ্যভূমি, হরিপুর উপজেলার কামারপুকুর বধ্যভূমিসহ হাতে গোনা কয়েকটি বধ্যভূমিকে সংস্কার করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও অসংখ্য বধ্যভূমি অবহেলিত অমর্যাদা সম্পূর্ণভাবে পড়ে রয়েছে এমনকি অনেক বধ্যভূমি সংরক্ষণের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

অবহেলিত বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পুলিশ লাইনের পাশে মাদ্রাসা মোড়ের গণকবর, সুগার মিলের মূল গেটের বাম পাশের গণকবর, ফারাবাড়ি হাটের কুয়া, রুহিয়া রামনাথ বাজারের গণকবর, পীরগঞ্জ উপজেলার পীরডাংগী বধ্যভূমি, গদাগারীর বধ্যভূমি, পয়েন্ধা চৌধুরীপাড়া বধ্যভূমি, বেগুনগাঁও বধ্যভূমি, দেশিয়াপাড়া বালুরঘাট চাটিয়াডাঙ্গা বধ্যভূমি, রানীশংকৈল উপজেলার ললদিঘী বধ্যভূমি, কাজির হাট চৌরাস্তা বধ্যভূমি, কাশিপুর ঝারবাড়ি বধ্যভূমি, হরিপুর উপজলোর বুজরুক বধ্যভূমি, মানিকখারী বধ্যভূমি, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার তীরনই নদীর খুটামনি বধ্যভূমি, কুশলডাঙ্গী বধ্যভূমি।
 
গোবিন্দনগর মন্দির ও গণকবর
ঠাকুরগাঁও জেলা শহরে ঢোকার মুখেই সত্যপীর ব্রিজসংলগ্ন ইপিআর (পরবর্তীতে বিডিআর এবং বর্তমানে বিজিবি ঠাকুরগাঁও সেক্টর হেড কোয়ার্টার) ক্যাম্পে ছিল হানাদার পাকিস্তানিদের হেডকোয়ার্টার। কুখ্যাত এই ক্যাম্পে দিনের বেলা অসংখ্য মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করা হতো। গোবিন্দনগর মন্দিরের গণকবরে ইয়াসিন আলীকে রেখে তাঁর চোখের সামনে ৫ সন্তানকে একে একে গুলি করে হত্যা করে ও উল্লাসে মেতে ওঠে পাকিস্তানি হানাদাররা। পরে মাটি খুঁড়ে কবর দেওয়া হয়। কিছুদিন পর ইয়াসিন আলীও মারা যান। ইসলামনগর ছিল আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। সেখানকার ছাত্রনেতা আহাম্মদ আলী, ইয়াকুব হোসেন, মোজাফফর, দবিরুল ইসলাম, নূরুজ্জামান ও সিরাজ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। পরে তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হয় টাঙন নদীতে। ঠাকুরগাঁও শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত টাঙ্গন নদীটি এ অর্থে একটা বধ্যভূমিও বটে।

রানীশংকৈল বধ্যভূমি
রানীশংকৈলের ক্যাম্পে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করে। কোনোরকম সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এখানে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে গণকবরগুলো।

ঠাকুরগাঁও পুলিশ লাইনে গণহত্যা
ঠাকুরগাঁও পুলিশ লাইনের পাশে রয়েছে সাত জোড়া কবর। ১৯৭১ সালে এখানে ছিল একটা কুঁড়েঘরের মাদ্রাসা। এই এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা চালায় এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষজনকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। এলাকার সমিরুদ্দীন, হাবিবুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, আবদুস সামাদ, শামসুল ইসলামকে এখানে গুলি করে হত্যা করে। এ কবরগুলো সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ঠাকুরগাঁও সুগারমিলে গণহত্যা
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে অনেকে তখন ভারতে চলে গেছেন। কিন্তু জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে ধরে থেকে গিয়েছিলেন সুগার মিলের গার্ড জহুর হোসেন, সিনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান আসগর আলী এবং কৃষি ব্যাংকের একজন গার্ড। পাকিস্তানি বাহিনী খবর পেয়ে তাদের তিনজনকে একত্রে গুলি করে হত্যা করে। মিলের প্রবেশের মূল ফটকের বাম পাশে তাঁদের জোড়া কবর রয়েছে। অবহেলায় পড়ে রয়েছে এই কবর।

জাঠিভাঙা বধ্যভূমি ও গণহত্যা
জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা এ জেলার নৃশংসতম গণহত্যাগুলোর মধ্যে সবচাইতে বড়। ঠাকুরগাঁও সদরের বালিয়া ইউনিয়নের কিসমত সুকানপুকুরী মৌজার জাঠিভাঙা গ্রামটি এখন বিধবাপল্লী নামে পরিচিত। এখানে ২৩ এপ্রিল প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা। স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামসের সহায়তায় হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী জনগণের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে। এ নির্যাতন থেকে বাঁচতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া, শুখানপুকুরী, জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিংগিয়া, চন্ডীপুর, বাসুদেবপুর, মিলনপুর, গৌরীপুর, খামার ভোপলা, দিনাজপুরের বীরগঞ্জের পলাশবাড়ী ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার সংখ্যালঘু পরিবার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল কৌশলে তাদের জাঠিভাঙ্গা নদীর পাড়ে জড়ো করে হানাদার বাহিনীর দোসররা। রাজাকাররা খবর দিলে হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে সব নারী-পুরুষকে ঘিরে ফেলে। এরপর গুলি আর ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার পুরুষকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। একদিনেই আড়াইশ মহিলা বিধবা হয়। এখানে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে।

বয়েন্ধা চৌধুরীপাড়ার গণহত্যা
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বয়েন্ধা চৌধুরীপাড়ায় একই পরিবারের সাতজন মানুষকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করে। বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই এলাকায় রুটিন মাফিক হত্যাকান্ড পরিচালনা করত।

ফাড়াবাড়ি হাটের বধ্যভূমি
ঠাকুরগাঁওয়ের ফাড়াবাড়ি হাটের বধ্যভূমি এলাকায় রয়েছে একটি কুয়া। এখানে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে অবাঙালি বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৮ জন মানুষকে ধরে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে। পরে লাশগুলো কুয়ায় ফেলে দেওয়া হয়। এটিও অবহেলায় পড়ে আছে।

রুহিয়ার রামনাথ হাটের গণকবর
১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া ছিল সদর থানার একটি ইউনিয়ন। তবে বর্তমানে সেটা রুহিয়া থানা। রামনাথ হাটের কানিকশালগাঁ গ্রামের নুরুল ইসলামের পরিবারের ছয়জনকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। ছয় শহীদ হলেন রফিকুল ইসলাম (আবুল), আজিম উদ্দিন আহমেদ, আজিম উদ্দিন আহমেদের নাতি মো বেলাল (বেলু), তাঁর ছোট ভাই মো জালাল, মো রেজাউল ও দেলোয়ার। এটি সংরক্ষণেও কোনও উদ্যোগ নেই।

তেঁতুলতলা ফার্ম গণহত্যা
পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে তৎকালীন পীরগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা ডা. সুজাউদ্দিন, আতাউর রহমান, আবদুল জব্বার ও মোজাফফর আলীসহ সাতজন রাজনৈতিক নেতাকে ধরে নিয়ে এসে পীরগঞ্জ-ঠাকুরগাঁও পাকা সড়কের তেঁতুলতলা ফার্মে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। শহীদদের মধ্যে ছিলেন জেলার একমাত্র শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য পীরগঞ্জ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা। শহীদ অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফার কবর পীরগঞ্জ রেলক্রসিং এ, সেটিও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। তেঁতুলতলায় একটি নামমাত্র স্মৃতিস্থম্ভ অযতেœ পড়ে আছে। শহীদ গোলাম মোস্তফা স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

দেশিয়াপাড়া বধ্যভূমি
পীরগঞ্জ উপজেলার ভোমরাদহ ইউনিয়নের দেশিয়াপাড়া এলাকায় স্থানীয় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে গণহত্যা চালানো হয়। পরে তাঁদের লাশ একই গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়। কিন্তু কোথাও স্মৃতিসৌধ নেই। এই স্থানগুলো সংরক্ষণও করা হচ্ছে না।

বালিয়াডাঙ্গি বধ্যভূমি
বালিয়াডাঙ্গির মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও স্বাধীনতা পরবর্তীতে ৬ বারের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম ও প্রাক্তন উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলীর পিতা আকবর আলীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। একই থানার ঝিকরগাছা গ্রামের ২৫ জন নিরীহ লোককে বাড়ি থেকে বালিয়াডাঙ্গি ক্যাম্পে ধরে এনে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এই উপজেলার গণকবরগুলো রয়েছে অরক্ষিত।

খুনিয়াদীঘি বধ্যভূমি
খুনিয়াদীঘি গণহত্যা পাক সেনাদের বর্বরতম হত্যাকান্ডের একটি। এর নাম শোনেননি ঠাকুরগাঁওয়ে এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। রানীশংকৈল থানায় ছিল পাকিস্তান সেনাদের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সহযোগিতায় ধরে আনা হতো অগণিত বাঙালিকে এবং নির্যাতনের পর হত্যা করে এই খুনিয়াদীঘিতে ফেলে দেওয়া হতো। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তিন হাজারেরও বেশি বাঙালিকে হত্যা করে খুনিয়াদীঘিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। খুব কম লাশই তারা মাটি খুঁড়ে গর্তে পুঁতে রাখত। পাকিস্তানি সেনারা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে টাঙন নদে ফেলে দেয়। খুনিয়াদিঘী বধ্যভূমি রাণীশংকৈল উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে সেখানে একটি স্মৃতিস্থম্ভ করা হয়েছে।

পীরডাঙ্গী বধ্যভূমি
পীরগঞ্জের পীরডাঙ্গি বর্বর ও নৃশংসতম গণহত্যার অন্যতম দৃষ্টান্ত। ১৯৭১ সালে কারবালা প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল এটি। পাকিস্তানি হানাদারেরা পীরডাঙ্গীকে বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। স্বাধীনতার পর লাচ্ছি নদীর কোল ঘেঁষে একটি জনমানবহীন বিস্তীর্ণ ধু ধু প্রান্তর জুড়ে অসংখ্য বাঙালির মাথার খুলি, বুকের পাঁজর, হাত-পায়ের হাড় ও রক্তমাখা কাপড় পাওয়া গেছে। হানাদারদের নির্মমতা এতই অত্যধিক ছিল যে বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের ধরে এনে জীবন্ত অবস্থায় তাদের শরীরের মাংস কেটে কুকুরকে খাওয়ানো হয়েছে। হত্যা ছিল হানাদারদের কাছে উৎসবের মতো। পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত মানুষকে পোড়াতে পোড়াতে তারা আনন্দ করতো। ইচ্ছেমতো গলা কেটে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে নিরীহ বাঙালিদের।

ইতিহাসের নির্মমতার সাক্ষী এই বড় গণকবরটি এখনও অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। ৪৯ বছরেও চিহ্নিতকরণ কিংবা খননের উদ্যোগ না নেওয়ায় কালক্রমে বধ্যভূমিগুলোর অবস্থানও হারিয়ে যাচ্ছে। পীরগঞ্জের সাংবাদিক আজম রেহমান দাবি করেন, সেসময় এখানে প্রায় ২শ’ মানুষকে হত্যা করা হয়। পাশের গ্রামের আলাউদ্দিন জানান, তার বাবা জামালউদ্দিনসহ একই পরিবারের ৮ জনকে এখানে হত্যা করা হয়। কিন্তু গণকবরটিকে সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে এক মায়ের ৪ সন্তান জামালউদ্দিন আহমেদ, লতিফর রহমান, হাসান আলি ও আজিজুর রহমানকে এখানে হত্যা করা হয়।

ইসলামনগর (খানকা শরীফ) বধ্যভূমি
৭১ এর মে মাসে খানকা শরীফ নামের ইসলামনগর মহলটি ঘেরাও করে। জড়ো হওয়া আতঙ্কিত মানুষগুলোর কাছে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আফজাল ও ক্যাপ্টেন হারুন অর রশিদ জানতে চায়, গত নির্বাচনে তারা কোন দলকে ভোট দিয়েছে। কয়েকজন অকপটে আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার কথা বলে। কেন তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন জানতে চাইলে কারণ ব্যাখ্যা করেন স্থানীয় ডা. মোস্তফা আহম্মেদ। এরপর এক সেনা কর্মকর্তা একটা তালিকা বের করে কতগুলো নাম পড়ে শোনায়। এঁদেরকে আগামীকাল সকাল ১০টার মধ্যে ক্যাম্পে হাজিরা দিতে বলে। নইলে এই মহল্লার সবাইকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়। এরপর সেনা কর্মকর্তা দুজন বাহিনী নিয়ে ইসলাম নগর ছেড়ে যায়। সারারাত অনেক ভাবনা-চিন্তা ও পরামর্শ করে এলাকাবাসী ঠিক করলো তালিকাভুক্তদের ক্যাম্পে হাজিরা দিতে পাঠাবে তারা। সেদিন কাউকে হত্যা না করায় তাঁদের ধারণা হয়েছিল ক্যাম্পে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তখন  কোনও যানবহন না থাকায় পরদিন সকালে গরুর গাড়িতে করে তালিকাভুক্ত ৭জন ঠাকুরগাঁওয়ের ইপিআর ক্যাম্পে হাজিরা দিতে যায়। এঁদের মধ্যে খানকা শরীফের পীর সাহেব মরহুম মো. শামসুজ্জোহার ছোট ছেলে ও ডা. মোস্তফা আহম্মেদের ছোট ভাই ছাত্র আহম্মেদ হোসেন (১৯) এবং স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এসএমএ ইসলামুল হক (৫৫), মো. মাহাদি ওরফে দবিরউদ্দিন (৩২), সিরাজউদ্দিন আহম্মদ (৫৫), ইয়াকুব হোসেন (৪৫), মাজহারুল ইসলাম (৪৫) ও মো. নুরুজ্জামান (৩৬) ছিলেন। তারা ক্যাম্পে যাওয়ার পর কী ঘটেছিল তা অনেক খোঁজ করেও জানতে পারেনি স্বজনরা। পরে জানা যায়, ২৪ মে তাঁদেরকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় টাংগন নদীর পুরোনো সেতুর কাছে এক বধ্যভূমিতে। সেখানে আরও ৮ জনের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁদের। দেওয়া হয় মাটি চাপা। এখানে আর ৮ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে তাঁদের সঙ্গেই মাটি চাপা দেওয়া হয়। এই ৮ জনকে ধরে আনা হয়েছিল বালিয়াডাঙ্গী থেকে। এঁদের পরিচয় জানা যায়নি। অন্য সূত্রেও উল্লেখ আছে-পাক সেনারা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে টাঙ্গন নদীতে ফেলে দেয়। ইসলামনগরের খানকা শরীফে নৃশংসতার সাক্ষী এই বধ্যভুমিটি চিহ্নিত করে বাঁধানো হয়েছে।

এছাড়া হরিপুর বধ্যভূমি রয়েছে। বিস্মৃতির গহবরে তলিয়ে গেছে এমন গণকবর বা বধ্যভূমি থাকাও বিচিত্র নয় বলে মনে করছেন অনেকে।

জেলার জীবিত মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকদের অন্যতম ঠাকুরগাঁও পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আকবর হোসেন বলেন, ৭১ এর শহীদদের সমাধি, গণকবর, বধ্যভূমি এগুলো সংরক্ষণের জন্য ৫০ বছর লাগার কথা নয়। এটা জাতি হিসেবে আমাদের মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারারই চিহ্ন বহন করে।

বর্তমানে পীরগঞ্জ রাণীশংকৈলের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক, প্রবীণ কৃষক নেতা বর্তমানে অসুস্থ সাবেক এমপি শহীদুল্লাহ শহীদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রক্ষায় ও তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবার অনেক কাজ এখনও বাকি। জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য এ কাজটিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

বধ্যভূমিগুলোর বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান বাবলু বলেন, মহান স্বাধীনতার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ের হাজার হাজার মানুষকে ধরে নির্মম ও পাশবিকভাবে হত্যা করা হয়। সেই স্মৃতির কথা মনে করলে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা যাদেরকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে, আজও আমরা তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো অনেক বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়নি। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করেছি। আর এখনো যদি আমাদের বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য কথা বলতে হয় এমন লজ্জা রাখার জায়গা থাকে না।

তিনি আরও বলেন, আর ক’দিন পরে একজনও মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একদিন আমরা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো। তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কে তুলে ধরবে নতুন প্রজন্মের কাছে! বধ্যভূমিগুলোকে সংরক্ষণ করে মূল্যায়ন করার দাবি জানান তিনি।
 
জানাতে চাইলে, ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান জানান, সরকারিভাবে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ হয়েছে, তার কাজ চলছে। তবে কোন বধ্যভূমি যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে থাকে, তাহলে জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সেই জায়গাগুলো সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।