স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের অন্যতম রূপকার ও বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর প্রয়াত জননেতা আব্দুর রাজ্জাকের ঘরোয়া আলাপের সুত্রধরে আজকের এ উপস্থাপনা।
ঘঠনাটি ১৯৭২ সনের। মে মাসের সাদামাঠা এক সকালে গ্রাম থেকে আসা ৩০/৩৫ জন মলিন বস্ত্রধারী জড়ো হয়েছেন ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সম্মুখে। আগের যোগাযোগের ভিত্তিতে তারা ঢাকায় এসেছেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষতের আশায়। কিন্তু গণভবনের বিধি নিষেধের কারণে তাদের আশাভঙ্গ ঘটেছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা পরদিন জড়ো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সম্মুখে।
সকাল নটায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়ী বাসা থেকে বের হবার সময় সবাই একজোট হয়ে এগিয়ে আসলে পুলিশ লাঠি চার্জে উদ্যত হলে বঙ্গবন্ধুর নজর পড়ে আগতদের প্রতি। অমনি গাড়ী থেকে নেমে হাক ছাড়লেন -এই পুলিশ খামোশ। পুলিশ থেমে গেলে। আগতদের কেউ কেউ মুজিবভাই বলে ,আবার কেউ কেউ লীডার সম্বোধন করে ছুটে আসে। আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু বল্লেন -তোরা কই থেকেরে এতো সকালে? তাদের বয়ান শুনে বল্লেন-তোরা আমাকে কি আর পাবেরে! আমিতো এখন প্রধানমন্ত্রী। বাসায় সবাইকে নিয়ে বসালেন। বেগম মুজিবকে ডেকে বল্লেন ,এতোজনের নাস্তা বাসায় হবেনা। বাহির থেকে নাস্তা আনাও। এরাতো আধপেটা হয়ে আছে।ফোন করাহলো রাজ্জাক সাহেবকে তাড়াতাড়ি চলে আসার জন্য।ইতিমধ্যে সবার সাথে আলাপ করে বঙ্গবন্ধু প্রত্যেকের হালঅবস্থা জেনে নিয়েছেন। রাজ্জাক সাহেব আসার পর বঙ্গবন্ধু বল্লেন , তোরা জানিসনা। দল ছাড়াও আমার একটি বিশেষ মিনিদল আছে দেশব্যাপী। এরা এই দলের কর্ম্মী। আরও অনেকে আছে। কেউ কেউ মারাও গেছে। যারা এসেছে তারা কোনক্রমে পথ খর্চ যোগাড় করে এসেছে। অনেকে হয়তো আসতে পারেনি টাকার অভাবে।তিনি আরও বলেছিলেন ,হুজুরতো (মাওলানা ভাসানী ) পীর সাহেবও। দেশব্যাপী আছে তার মুরীদান। তাদের নিকট থেকে তিনি দেশের আসল অবস্থা বুঝে নিতে পারেন। আমিতো পীর নই। সেই ৫৪ সনের নির্বাচনের সময় প্রত্যেক এলাকায় গিয়ছি এবং জনসংযোগ করেছি। নির্ভেজাল সমর্থক থেকে তালিকা তৈরী করেছিলাম পছন্দ অনুযায়ী। তালিকায় ছয়শ জনেরও অধিকের নাম ছিলো। কেউ কেউ মারাও গেছে। তাদেরকে পৃথকভাবে ডেকে এনে দেশের হাল অবস্থা জানতাম। তাদের খবরটাই ছিলো নির্ভেজাল। কারণ এরা থাকে মাটি ও মানুষের সাথে। তাদের খবর গোয়েন্দাদের চাইতে বেশী উত্তম। দলের নেতাদের খবরও তাদের নিকট থেকে নিতাম। এ যোগসুত্রটি.জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ছিলো।তাই ঢাকাতে বসেও পল্লী গ্রামের খবর জানতাম। এখন কি তা সম্ভব হবে? আব্দুর রাজ্জাককে তিনি বলেছিলেন -আজ থেকে ওদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব তোর উপর বর্তালাম। লিস্ট খোঁজে পাবোনা এখন। ওদের একে অন্যের যোগাযোগ আছে। তাদের নিকট থেকে একটি তালিকা তৈরী করতে হবে। বলা বাহুল্য, আগতদের অনেকেই তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছিলো নিজ ঘরের আতপ চাউল ,ফলানো আনাজ , চিড়ার নাড়ু এমনকি ঘরের তৈরী সন্দেশও তাদের নেতার জন্য। এসমস্থ দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিলেন ,দেখ আমার জন্য ওদের কি মায়া! আমি ওদেরকে ভুলি কেমনে?
প্রয়াত লীডার আব্দুর রাজ্জাক যখন এ স্মৃতি চারণ করছিলেন তখন আমার মানসপটে ভেসে উঠেছিলো তিনটি পরিচিত মুখ। প্রথমজন হচ্ছেন চাঁদপুরের আব্দুল করিম। তিনি ছিলেন করাতী সর্দার।সত্তুর দশকের শেষ দিকে তার সাথে পরিচয় ঘটেছিল আমার নিজ গ্রামে। তখনও করাতকলের তেমন বিস্তৃতি ঘটেনি। করাতিরা গ্রামে গ্রামে হেঁটে গাছ কেঁটে হাতকরাত দিয়ে কাঠ চিরাই করতো। করিম ছিলেন তিনজন করাতীর সর্দার। বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে তিনি হাঁউ মাউ করে কাঁদতেন। বলতেন ,এমন নেতা এদেশে আর পয়দা হবেনা। শুয়রের বাচ্চারা তাকে মেরে ফেললো। তাকে নিয়ে আমার কৌতুহল জেগেছিলো। কথা প্রসংগে তিনি বলেছিলেন -শেখ সাবেরে আমি ভালোভাবে চিনি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থাইক্যা। হে মিয়া আমারে ডাকাইয়া নিতো ঢাকাতে। করিম সর্দারের কথা সেসময়ে বিশ্বাস করলেও সন্দেহ থেকে যেতো। অপরজন সিলেটের দক্ষিন সুরমার.ছাদউল্লা।কীনব্রীজের দক্ষিণ প্রান্তে বসে বুটবাদাম মটর ও মুড়ির লাড্ডু বি্ক্রয় করতেন। ১৫ আগষ্টে তিনি বাদাম ফ্রী খাওয়াতেন। রেগে গেলে তিনি বলতেন -শেখ সাবেরে আমার চাইতে কোন হালায় বেশী বুঝবে? রেফারেন্ডাম থেকে আমি তাকে চিনি।সাথে সাথে ঘুরতাম আর বাদাম চিবাতাম। ঢাকাতে গিয়েও তার সাথে কথা বলতাম। তিনিও বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে শিশুর মতো কাঁদতেন। অপরজন ছিলো শ্রীমঙ্গলের মতিগন্জ এলাকার। নাম ভুলে গেছি। তার প্রতিকী নাম পড়েছিলো "মতিগন্জের নৌকা। তিনি বলতেন -ডালিমকে সামনে পেলে আমি নিজে মরেও তাকে মেরে ফেলব। চুদির পুতে আমার লীডারকে খুন করছে। তিনি বলতেন - লীডার আমাকে ঢাকায় ডাকতেন। তিনির বাসায় গিয়ে একদিন দুপুরে খেয়েছিও গুলশা মাছ দিয়ে। কথাটিকে কেউ বিশ্বাস করতো আবার কেহ ভড়ং বলে উড়িয়ে দিতো। রাজ্জাক ভাইয়ের বয়ান শুনে প্রাগুক্ত আবদুল করিম ছাদ উল্লা এবং মতিগন্জের নৌকা নামধারীর প্রতি আমার বিশ্বাসের ভিত মজবুত হয়েছিলো। তারা হয়তো বেঁচে নেই। হারিয়ে গেছেন অনীহার অন্ধকারে। একই সাথে রাজনীতির থিওরী পরিবর্তনের পাশাপাশি রঙ্গেরও পরিবর্তন হচ্ছে সমান মাত্রায়।
মাওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলে বসে এবং বঙ্গবন্ধু ঢাকাতে বিচরণ করে গোটা দেশের পালস পরিমাপ করতে পারতেন সহজে। হাঁড়ির একটি ভাতে আঙ্গুলটিপ দিলে যেমনি গোটা হাঁড়ির খবর জানা যায় তেমনি সাধারণ একটি মানুষের অবস্থা প্রখর দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গোটাদেশের মানুষের অবস্থা অনুমান করার মতো চুম্বক শক্তি ছিলো উক্ত দুই নেতার। শীর্ষ এ দুই নেতার আদলে অধঃস্তন পর্যায়ে অনুরূপ নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো বলেই জনবিষ্ফোরণের পাশাপাশি জন বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হয়েছিলো। সাথে সাথে ইতিহাসেরও বাঁক পরিবর্তনও সূচিত হয়েছিলো।
এখন রাজনৈতিক অঙ্গণে নেতা প্রজননের পাশাপাশি চলছে নেতৃত্বের প্রতিযোগীতা। লব্রীড হাইব্রীড নিয়ে চলছে বাদানুবাদ। এ সমস্থ নেতাদের জনসম্পৃক্ততা কেমন আছে সেটি খতিয়ে দেখার দরকার পড়েনা। দল আছে ,দলের সাইনবোর্ড ও প্রতীকই তাদের ব র্তে থাকার বড় হাতিয়ার ও ভিত্তি। এলাকা দূরের কথা নিজ পরিবারের খবরকি তাদের গোচরে আছে? জননেতার অভিধা আছে। কিন্তু জন অনিভূতি,চোখের ভাষা ও অবস্থান নির্ণয়ের হেকমত তাদের নেই বলেই জনগন সরে যাচ্ছে দূরে এক অনিশ্চিত পরিমন্ডলের দিকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট