ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
ভোলার সংগ্রামী নারী-কল্পনা

৩৫ বছর ধরে চালাচ্ছে খাবার হোটেল

মিজানুর রহমান-ভোলা প্রতিনিধি : | প্রকাশের সময় : শনিবার ১২ মার্চ ২০২২ ০৪:২৯:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

হাজারো খাবারের হোটেলের ভিড়ে ছোট্ট একটি খাবার হোটেল ‘কল্পনা হিন্দু হোটেল’। বড় কোন পরিসরে নয় ছোট্ট পরিসরে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে ভোলা শহরের উকিল পাড়ায় এই হোটেল চালিয়ে আসছে সংগ্রামী নারী কল্পনা রানী মজুমদার। সংসারে হাল ধরতে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এই নারী একাই চালিয়ে আসছে খাবার হোটেলটি। বর্তমানে চাকচিক্কতার ভিড়ে নিজের হোটেলটি টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো ঘাম জড়াচ্ছেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে এই চাপ যেন আরো বেড়ে গেছে কল্পনার। ছোট শহরের নানাজনের কটু কথা শুনেও থেমে যাননি এই সংগ্রামী নারী। নিজেই রান্না করে খাবার পরিবেশন করা, স্বল্প মূল্যে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করায় শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাস্টমাররা ছুটে যান খাবার খেতে। খাবার খেতে আশা কাস্টমরা বলছেন এই হোটেলের খাবার দামে কম মানে ভালো ও সুস্বাদু তাই ছুটে আসি। স্থানীয়রা জানান, সবার সহযোগীতা পেলে বড় পরিসরে হোটেল ব্যবসা করতে পারবে। আর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর বলছেন, কল্পনা রানী একজন সংগ্রামী নারী। তার এগিয়ে চলার জন্য সব ধরণের সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হবে সরকারে পক্ষ থেকে।

সংগ্রামী নারী কল্পনা রানী জানান,সুখের আশায় শহরের এক বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। কিন্তু সেই সুখ তার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বিয়ের পর  থেকেই স্বামীর সংসারেও অভাব ও কষ্ট লেগেই থাকতো, এর মধ্যে ছেলে সন্তানের আশায় পর পর ৪টি কন্যা সন্তানের জন্মদেন। শ্বশুর শড়দা কান্ত মজুমদার মারা যাওয়ার,কিছুদিন পরে স্বামীও অসুস্থ্য হয়ে বিছনায় পড়ে যায়।

জীবিকা আর সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শ্বশুরের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে হোটেলের হাল ধরেন কল্পনা রানী। একাই হোটেলের জন্য বাজার করে আনা,রান্না করে কাস্টমরাকে পরিবেশন করেন খাবান তিনি। অল্প বয়সে খাবার হোটেলটি পরিচালনা করতে গিয়ে নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে আগলে রাখেন  ও সন্তানদের মানুষ করেন তিনি। হোটেলের আয় দিয়ে অসুস্থ্য স্বামীর সুস্থ্য করার জন্য প্রানপন চেষ্টা চালান। অন্যদিকে ৪টি মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। হঠাৎ স্বামী জিতন্দ্র চন্দ্র মজুমদার এর মৃত্যুর পরে যেন আরো একটি ঝড় নেমে আসে তার জীবনে। তবুও থেমে থাকেনি, দুঃখকে শক্তিতে রুপান্তর করে আবার ঘুরে দাঁড়ায় কল্পনা।

তিনি জানান,সংসার চালানোর জন্য হোটেলের দায়িত্ব নিতে হয় আমাকে। প্রথম দিকে হোটেল রাস্তার পাশে থাকায় কাস্টমার ভালোই আসছিলো। পরে করোনার মধ্যে হোটেল ভাড়া দিতে না পারায় ঘর মালিক অন্যত্র দোকান ভাড়া দিয়ে দেয়। পরে খাবার হোটেল ভিতরে নিতে হয়। ফলে শহরের কাস্টমারের ভাটা পরে। যা আয় হতো তা দিয়ে খরচ বাদ দিয়ে কোন রকম সংসার চলাতাম। এই দিয়ে ৩টা মেয়েকে বিয়ে দিলাম। এখন ছোট মেয়েটার  নার্সিং পড়ার সখ পুরণ করতে পারলেই আমার শেষ বেলায় এসে কিছুটা তৃপ্তি পেতাম। তা নাহলে অতৃপ্তিই থেকে যাবে।

কল্পনা আরো বলেন, বয়সের ভাড়ে শরীরে বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। টাকার অভাবে চিকিৎসাটা ঠিক মতো করতে পারছিনা। হোটেলের কাস্টমার ধরে রাখার আসায় মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি কিংবা বাবার বাড়িতে গিয়ে ২/১ দিনও থাকতে পারিনা। যদি কাস্টমার ছুটে যায় এই ভয়ে।

তিনি জানান, করোনার সময় সরকার কত প্রনোদনা দিয়েছে আমরা কিছুই পাই নাই। এখন দিন দিন কাষ্টমার কমে যাচ্ছে, তা ছাড়া নিত্যপন্যের যে দাম তাতে খরচ বেড়ে গেছে, ব্যবসা কমেছে, করচ বাদে তেমন একটা ব্যবসা এখন আর হয়না। এখন কাস্টমার আর আগের মতো আসতে চায়না। এখন সরকার যদি আমাকে একটু সহযোগীতা করে তাহলে ভালো করে হোটেলটা চালাতে পারতাম আর মেয়েটাকে নার্সিং ভর্তি করতে পারলে আমার স্বপ্ন কিছুটা পূরণ হত।

কল্পনা হোটেলে খাবার খেতে আসা রুহী দাশ রাজ হংসি জানান, কল্পনাদির হোটেলে কম দামে সুস্বাদু খাবার খাওয়া যায়। তাই আমরা প্রতিদিন খাবার খেতে আসি। এখানে খাবারে মান খুবই ভালো। অল্প টাকায় ঘরোয়া খাবার খাওয়া যায়। এছাড়ার কল্পনাদি নিত্যান্তই অসহায় একজন নারী। সংগ্রাম করে টিয়ে আছে এই খাবার হোটেল ব্যবসায়। এই বিষয়টি আমাদের খারাপ লাগে। তাই আমরা এখানে মানবিকতার জায়গা থেকে হলেও খেতে আসি। সর্বোচ্চ একশ টাকায় আমরা পেট ভরে খেতে পারি। যা বাইরের কোন হোটেলে খেলে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ হতো।

আরেক কাস্টমার পরিমল জানান, আমি কল্পনাদির হোটেলে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে খাবার খাই। পাবনা থেকে লঙ্গি, গামছা এনে ভোলাতে বিক্রি করি। যে টাকা বিক্রি করি তা দিয়ে নিজে টিকে থাকা কষ্টকর। কল্পনাদির হোটেলে অল্প টাকায় পেট পুড়ে খেতে পারা যায়। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন খেতে আশি। এখানকার রান্না খুবই সুস্বাদু। এখানে ৫৫ টাকার মধ্যে মাছ, শাক দিয়ে ভাত খেলাম। 

বড় মেয়ে মনিকা রানী জানান, আমার বাবা হঠাৎ অন্ধ হয়ে গিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বিছানায় পরে ছিলো। আমাদের মাই হোটেল চালিয়ে কষ্ট করে আমাদের পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করছে। ৩ বোনকে বিয়ে দিয়েছে। মার কারণেই আমরা সবকটি বোন পড়াশোনার করতে পেরেছি। এখন সরকার তো নারীদের উদ্যোক্তা করতে অনেক টাকা পয়সা দিচ্ছে। আমার মার জন্য কিছু করলে আমাদের ব্যবসাটা আরো ভালো করে চালাতে পারতাম।

উন্নয়ন কর্মী আইসিডিএসের নির্বাহী পরিচালক মর্তূজা খালেদ বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা কর্মসংস্থান থেকে অনেকাশেংই বঞ্চিত। এখানকার অধিকাংশ নারীরা সাংসারিক কাজ ছাড়া তেমন কোন কাজ পায় না। ফলে সংসার সামলেই জীবন পরিচালনা করে থাকেন। সেই দিক থেকে কল্পনা রানী নারীদের জন্য অনুকরনীয় হতে পারে। জীবন চলার জন্য খাবার হোটেল ব্যবসা পরিচালনা করছে কল্পনা এটি খুবই  ভালো দিক। দেশের উন্নয়নের জন্য এই ধরনের কর্মঠ নারীর পাশে দাঁড়ানো উচিত সকলের।

জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, কল্পনা রানী একজন সংগ্রামী নারী। তিনি এই হোটেল ব্যবসা করে তার মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সামনের দিন গুলোতে যেন আরো ভালো করতে পারে তার জন্য তার পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ঋণের ব্যবস্থা গ্রহন করবো। যাতে সে ভালো ভাবে প্রতিষ্ঠানটি দাড় করাতে পারে।