দেশের সর্ববৃহত শিল্পাঞ্চল সাভার ও আশুলিয়া নানা সঙ্কটের জেরে ৩০টি কারখানা ছুটি দেওয়া হয়েছে। মূলত সহিংসতা, বে-আইনী ও অযৌক্তিক ধর্মঘট, বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় পোশাক কারখানা গুলো ছুটি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ২২টি কারখানা। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় কারখানাগুলো বন্ধ করা হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী কারখানা যতদিন বন্ধ থাকবে শ্রমিকরা ততদিনের মজুরি পাবেন না।
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ঢাকার আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত কারখানাগুলোর সামনে অনির্দিষ্টকালের বন্ধের নোটিশ ঝুলছে । এর মধ্যে বেশিরভাগ কারখানাই মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) এ নোটিশ টানিয়েছে।
মঙ্গলবার শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য আশুলিয়ার যেসকল কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে সেগুলো হলো- অরুনিমা গ্রুপের ২টি প্রতিষ্ঠান অরুনিমা স্পোর্টস ওয়্যার, ডিএমসি এ্যাপারেলস, এনভয় গ্রুপের ৩টি প্রতিষ্ঠান মানতা এ্যাপারেলস, এনভয় ফ্যাশন্স, এনভয় ডিজাইন, ফ্লোরেন্স গ্রুপের সিগমা ফ্যাশন্স লি., শারমিন গ্রুপের ইশায়াত এ্যাপারেলস লি., হামীম গ্রুপের ৬টি প্রতিষ্ঠান দ্যাটস ইট স্পোর্টস ওয়্যার, এ্যাপারেলস গ্যালারী লি., রিফাত গার্মেন্টস, এক্সপ্রেস ওয়াশিং এন্ড ডাইং, আর্টিস্টিক ডিজাইন, নেক্সট কালেকশন্স, ডেকো গ্রুপ, এছাড়া ডেবোনেয়ার লি., ক্রসওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ, স্টারলিং স্টাইলস, বান্দো ডিজাইন, মন্ডল নিটওয়্যারস লি., এআর জিন্স প্রডিউসার, সাদ ফ্যাশন্সসহ প্রায় ২২ টি কারখানা।
জামগড়া এলাকার এন আর এন নিটিং এন্ড গার্মেন্টস লি. গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকেই ১৩(১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। একই ধারায় টঙ্গাবাড়ি এলাকার ওয়াশ এন্ড ওয়্যার লি. বন্ধ রয়েছে গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে।
শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় উল্লেখ আছে “কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা বিভাগে বে-আইনী ধর্মঘটের কারণে মালিক উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন, এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকগণ কোনো মজুরি পাইবেন না।”
গত মঙ্গলবার আশুলিয়ার বেশিরভাগ কারখানাতেই শ্রমিকরা কাজে যোগদান করেছিল। কিন্তু দুপুরের দিকে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার এনভয় কমপ্লেক্স, নরসিংহপুর এলাকার শারমিন ও হামীম গ্রুপে অসন্তোষ শুরু হলে কারখানা ছুটি দেয় কর্তৃপক্ষ।
এনভয় কমপ্লেক্সের প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপকের স্বাক্ষরকৃত বন্ধের নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, “গত ০৮-০৯-২০২৪ ইং তারিখে কারখানার শ্রমিকগন শ্রম আইন বহির্ভূত অবৈধ ও অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে নিজ নিজ কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়। কর্তৃপক্ষ বার বার তাদেরকে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করার জন্য অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা কাজ না করে বসে থাকেন। অতঃপর কারখানা ও শ্রমিক/কর্মচারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কারখানা কর্তৃপক্ষ দুপুর ০২:৪০ ঘটিকায় ছুটি ঘোষনা করেন এবং পরবর্তী দিন ০৯-০৯-২০২৪ ইং তারিখ সাধারণ ছুটি হিসেবে কারখানা বন্ধ রাখেন।
অনুরুপভাবে ১০-০৯-২০২৪ ইং তারিখে শ্রমিকরা যথাসময়ে কারখানায় প্রবেশ করে কার্ড পাঞ্চ করে কাজ না করে বসে থাকলে কর্তৃপক্ষ পুনরায় তাদেরকে স্বাভাবিক কাজ কর্ম শুরু করার জন্য বিভিন্নভাবে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা অনীহা প্রকাশ করে নিজ নিজ কাজ কর্ম বন্ধ রাখেন। একপর্যায়ে তারা উত্তেজিত হয়ে দুপুরের খাবার বিরতির পূর্বে উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে কারখানার বেশ কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর করে। এরুপ পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ অনুমান দুপুর ১:০০ ঘটিকায় ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। শ্রমিকদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড বে-আইনি ধর্মঘটের সামীল।
অতএব, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে “বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ১৩ (১) ধারা” অনুযায়ী আগামী ১১-০৯-২০২৪ ইং তারিখ হতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করছে। পরবর্তীতে কাজের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হলে কারখানা খোলার তারিখ নোটিশের মাধ্যমে জানানো হবে।”
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বেশ কিছু কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলে আশেপাশের কারখানাগুলোও নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ ঘোষণা করে।
এ বিষয়ে আশুলিয়ার কয়েকজন শ্রমিকনেতা বলেন, “কয়েক দিন ধরেই বিজিএমইএর সাথে মিটিং করে আমরা শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা কিছুতেই বুঝতে চাচ্ছেনা। তাদের হাজিরা বোনাস বাড়ানো হয়েছে, টিফিন বিল বাড়ানো হয়েছে, তাও তারা কারখানায় গিয়ে কাজ না করে কার্ড পাঞ্চ করে বের হয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা থাকায় কারখানা মালিকরাও চাপে আছেন, তাদের বায়ার ছুটে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় দেয়ালে পিঠ লেগে যাওয়াতেই তারা ১৩(১) ধারায় ছুটি দিয়েছে। এতে কিন্তু শ্রমিকদেরই ক্ষতি, তারা কাজ না করলে বেতন পাবেনা।
অন্যদিকে ডিইপিজেড সহ আশুলিয়ার অন্যান্য কারখানাগুলোতে স্বাভাবিক ভাবেই কাজ চলছে বলে খবর মিলেছে। বুধবার দুপুর বিকেল ৫ টা পর্যন্ত আশুলিয়ার সড়ক মহাসড়কে শ্রমিকদের কোন বিক্ষোভ কিংবা আন্দোলনের খবর পাওয়া যায়নি।
আশুলিয়া ও গাজীপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের চক্রবর্তী ও মোজারমিল বাসস্ট্যান্ড এলাকার আশেপাশের আরও কিছু কারখানা আজ ছুটি দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, বুধবার সকাল ৮ টায় গাজীপুর জেলাধীন বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকরা নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের চক্রবর্তী এলাকায় সড়ক অবরোধ করে। এর প্রেক্ষিতে গোলযোগের আশংকায় ওই এলাকার জিন্স প্লাস, শমসের নিট, ইয়ং সক্স লেবেল, কুশিয়ারা ফ্যাশন, ইউরো আর্তে ও সিনহা ডেনিম কারখানা সকাল ১০ টার দিকে ছুটি দিয়ে দেয়। তাদের মাসিক বেতনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার বিকেলে বিকাসে যথারীতি তাদের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ জানিয়েছে, ১৩(১) ধারায় প্রায় ২২ টি কারখানা ও বিভিন্ন কারণে আরও প্রায় ৮টি কারখানা ছুটি দেওয়া হয়েছে।