বেশ জোর দিয়েই হয়তো বলা যায়, সাধারণ বাঙালিকে টিউলিপ ফুল খুব ভালো করে চিনিয়েছিল ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া উপমহাদেশ মাতানো বলিউডের চলচ্চিত্র ‘সিলসিলা’। সেই থেকে টিউলিপ আর উইন্ডমিলের দেশ নেদারল্যান্ডসের ফুলে ছাওয়া প্রান্তরে অমিতাভ-রেখার ‘দুজনে দুজনার’ মুহূর্ত কয়েক প্রজন্মের স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে গেছে। তখন থেকে দুনিয়াটা হয়ে গেছে অনেক ছোট। রূপসী টিউলিপ সুদূরের দেশ আর রুপালি পর্দার স্বপ্নের জগৎ থেকে বাংলাদেশের মাটিতে শিকড় গেড়েছে এরই মধ্যে।
শীত-গ্রীষ্মের বাধা পেরিয়েছে প্রযুক্তি। গাজীপুর দিয়ে শুরু হয়েছিল টিউলিপের বাংলা জয়ের অভিযান। এবার তা শোভা ছড়াতে যাচ্ছে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে। এছাড়াও গদখালীর মাঠগুলোতে এখন শোভা পাচ্ছে রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্র মল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল।
এবারের শীত মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে নিবিড় যত্নে টিউলিপ ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন গদখালীর ফুল চাষি ইসমাইল হোসেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ইসমাইলের এই সাফল্যের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো গদখালীতে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো গরমপ্রধান দেশে টিউলিপ ফোটানো এখন পর্যন্ত রীতিমতো সাধনারই বিষয়। অপরিসীম ধৈর্য ধরে লেগে থেকে তাতে সফল হয়েছেন ইসমাইল হোসেন।
জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ইসমাইলের বাগানে দোল খেতে শুরু করেছে বাহারি রঙের টিউলিপ। তার বাগানজুড়ে সেজেছে নানা রঙের বাহারি রাজসিক সৌন্দর্যের এই ফুল।
দারুণ এ দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষ। সম্প্রতি ফুল দেখতে আসা কয়েকজন দর্শনার্থী বললেন, দেশে এই ফুল নতুন। গদখালীতে প্রথম ফুটেছে। তাই তারা আগ্রহ নিয়ে দেখতে এসেছেন।
ফুল চাষি ইসমাইল হোসেন প্রথমে টিউলিপ চাষ শুরু করেছিলেন পরীক্ষামূলকভাবে। এখন বাণিজ্যিকভাবে করার চেষ্টা করছেন। এ ফুল চাষে আগ্রহীদের সামনে উঠে আসা বড় সমস্যাটির কথা বললেন তিনিও। এ দেশে ফুল ফুটলেও পরবর্তীকালে রোপণের জন্য টিউলিপের বাল্ব (কন্দ) সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাল্ব সযত্নে সংরক্ষণ করতে হয়। সেই ব্যবস্থা করা সবার জন্য সম্ভব নয়। ইসমাইল হোসেন বলেন, বিদেশ থেকে বাল্ব আনতেও উল্লেখযোগ্য অঙ্কের শুল্ক লাগে।
গদখালীর ফুল চাষিরা বলেন, বাণিজ্যিক চাষের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টিউলিপ ফুলের জাত উদ্ভাবন করতে গবেষণা চলছে। তাদের প্রত্যাশা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে টিউলিপের পরীক্ষামূলক চাষ সাফল্যের মুখ দেখবে। ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন এর সাফল্যে দেখে ফুল চাষিরা আবারো নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। ফুলের বাজার ছাড়াও স্থানীয় পর্যটনশিল্পের প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে টিউলিপ।
গদখালীতে মাত্র ৫ শতক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপ লাগানো হয়েছে। কন্দ বপনের প্রায় এক মাসের মাথায় গাছ পরিণত হয়ে ফুল আসতে শুরু করেছে। বাণিজ্যিক সাফল্য পেলে আগামী দিনে আরো বেশি জমিতে টিউলিপ চাষ করা হবে বলে জানান কয়েকজন চাষি।
টিউলিপ চাষের ব্যাপারে ঝিকরগাছার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, ‘নেদারল্যান্ডস থেকে গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেনের মাধ্যমে সরকারি খরচে সাত প্রকারের পাঁচ হাজার বাল্ব আমদানি করি। ওই বাল্ব গদখালীর ইসমাইল হোসেনের ৫ শতক জমিতে গত ৬ জানুয়ারি বপন করা হয়। ২২ জানুয়ারি থেকে টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে সানরাইজ, অ্যান্টার্কটিকা হোয়াইট (সাদা), লা বেলা রেড (লাল), মিল্কশেক রেড (লাল) প্রজাতির টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। পর্যায়ক্রমে সাত প্রজাতিরই ফুল ফুটবে বলে আশা করি। আমরা ফুলের রাজ্য গদখালীকে মিনি নেদারল্যান্ডস হিসেবে পরিচিত করে তুলতে চাই।