ভারত থেকে ফেরার সময় মায়ের জন্য নতুন শাড়ি আর বোনের জন্য নতুন জামা ও মাটির কৃষ্ণ মূর্তি নিয়ে আনার কথা বলেই বাবা মহাদেবের হাত ধরে বাসা থেকে বিদাই নেয় জয়ন্ত। অথচ দুদিন পরে জয়ন্ত ফিরলো পঁচা লাশ হয়ে। এ কথা গুলি বলে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন বিএসএফ’র গুলিতে নিহত কিশোর জয়ন্ত সিংহের মা জুয়িতা রাণী। এসময় তার পাশে থেকে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে গামছা দিয়ে মুছে সমবেদনা জানাচ্ছেন প্রতিবেশি সৃজন বালা।
একই অবস্থা বোন ইস্মিতা রাণীরও। উপজেলার লাহিড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী ও জয়ন্তর বড় বোন ইস্মিতা বলে, আমার ভাইকে নিয়ে আমি স্কুলে যেতাম একসাথে। সে আমার স্কুলেই ৭ম শ্রেণিতে পড়তো। বাবার সাথে কদিনের জন্য ভারতের আত্মীয়ের বাসায় যাবার কথা বলে চলে যায় আর ফিরে লাশ হয়ে। বাবাও রংপুরে হাসপাতালে। আমার মাকে আমি বাঁচাবো কিভাবে আর আমিই বা আমার ভাইটাকে ছাড়া স্কুলে যাবো কি করে। আমার ভাইকে আমার মার বুকে ফিরিয়ে দেন কেউ। আমার চাইনা নতুন জামা, চাইনা কৃষ্ণ মূর্তি। শুধু আমার ভাইটাকে ফেরত দেন। নিহত জয়ন্তের বোন ইস্মিতার এ ধরনের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে পড়ে সেখানকার পরিবেশ। পিন পতনের শব্দ টুকুও হয়না কোথাও।
বুধবার রাত ১ টা ৩০ মিনিটে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বাংলাদেশ বিজিবির পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে নিহত কিশোর জয়ন্তর লাশ ফেরত দেয় ভারত। পরে আইনী প্রক্রিয়া শেষে পুলিশ লাশ নিহতের চাচা শ্রী বাবুল চন্দ্র সিংহের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাশ হস্তান্তরের সময় ভারতের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর ইসলামপুর থানার অফিসার ইনচার্জ হীরক বিশ্বাস, বিএসএফ এর ডিংগাপাড়া ১৫২ বিএসএফ ক্যাম্পের কম্পানি কমান্ডার সন্তোষ সিং এবং বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বালিয়াডাঙ্গী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) দিবাকর অধিকারী ও বাংলাদেশ বিজিবির ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি ব্যাটেলিয়নের ধনতলা বিওপির কম্পানি কমান্ডার মোজাম্মেল হক।
এর আগে, গত ৯ তারিখ সোমবার ভোরে জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্তে চোরাকারবারি চক্রের দালাল মিস্টার, দুলাল এবং কাজির উদ্দীন এর নেতৃত্বে কিশোর জয়ন্ত ও তার বাবা মহাদেব সহ ১৬ সদস্যের একটি দল উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের কান্তি ভিটা সীমান্তের মেইন পিলার ৩৯২/ ৪ এস এর পাশ দিয়ে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় তারা ভারতের একশ গজ অভ্যন্তরে দিঘলবস্তি নামক স্থানে পৌছালে ভারতীয় ডিংগাপাড়া ১৫২ বিএসএফ ক্যাম্পের জোয়ানরা কয়েক রাউন্ড গুলি করলে ঘটনাস্থলেই গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় জয়ন্ত। জয়ন্তর নিথর দেহ টেনে হিচড়ে আনতে গেলে গুলিবিদ্ধ হয় জয়ন্তর বাবা মহাদেব ও দরবার আলী। পরে তারা জয়ন্তকে ফেলে রেখেই পালিয়ে আসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। চোরাকারবারি চক্রের দালাল সহ অন্যরা পালিয়ে যায়। পরে জয়ন্তর লাশ ডিংগাপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যায় বিএসএফ জোয়ানরা। গুলিবিদ্ধ জয়ন্তর বাবা মহাদেব কুমার সিংহ (৪৫) এবং দরবার আলী (২৮) রংপুরের অজ্ঞাত কোন স্থানে চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানাযায়।
মরদেহ ফেরতের বিষয়টি নিশ্চিত করেন বালিয়াডাঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ কবির বলেন, ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি ব্যাটালিয়ন এর ধনতলা বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় রাত ১ টা ৩০ মিনিটে বিজিবি ও বিএসএফের উপস্থিতিতে ভারতীয় পুলিশ আমাদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করলে আমরা জয়ন্তের পরিবারের কাছে অর্থাৎ জয়ন্তর চাচা শ্রী বাবুল চন্দ্র সিংহের কাছে হস্তান্তর করি।
ঠাকুরগাঁওয়ের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট আব্দুল লতিফ এবং লেখক ও কলামিষ্ট আজমত রানা সীমান্ত হত্যা নিয়ে জানান, ফেলানির হত্যাকান্ডটি আমাদের মনে আজও দাগ কাটে। সীমান্তে এইযে বিচার বহির্ভুত যে হত্যাকান্ড গুলি ঘটে এটা কোনভাবেই মেনে নেয়ার মত না। আমাদের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মহল থেকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। সে সাথে আমাদের নাগরিকরা যে এভাবে সীমান্ত পার করছে এর জন্যে আমাদের বিজিবিকে আরো সতর্কভাবে সীমান্তে পাহারা জোরদার করতে হবে এবং প্রয়োজনে সীমান্তের চেকপোষ্ট গুলি বাড়িয়ে দিতে হবে।
ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল তানজির আহমদ জানান, বাংলাদেশ বিজিবির পক্ষ থেকে ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ভারতের বিএসএফকে তিব্র নিন্দা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। সীমান্তে বিচার বহির্ভুত কোন হত্যাকান্ডই কাম্য নয়। আমরা ভারতের হাইকমিশন পর্যন্ত এর নিন্দা জানিয়েছি এবং পরবর্তীতে সীমান্তে বিচার বহির্ভুত এ ধরনের হত্যাকান্ড এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে তাদের।