যোগদানের পর কয়েক কোটি টাকা সরানোর অভিযোগ উঠেছে সরকারি সোনাতলা মডেল স্কুল এন্ড কলেজ (পূর্ববর্তী নাম সোনাতলা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) এর প্রধান শিক্ষক মোঃ মতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে এলপিআরে যাবার আগে ৮ মাসেই ব্যাংক হতে তিনি উত্তোলন করেছেন ৪০ লক্ষ ১১ হাজার ৯৯৫ টাকা। এঘটনায় এলাকার শিক্ষানুরাগী ও সাংবাদিকেরা বিষয়গুলো জানার পর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার জানার চেষ্টা করলে তারা কোনভাবেই সাড়া দেয়নি। বরং বিভিন্নভাবে মামলা মোকদ্দমার ভয়, হুমকি-ধামকি, গালাগালি, ও ভয়ভিতী দেখায়। বিষয়গুলো উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবগত করলে তারাও কোন সহযোগিতা করেননি। বরং তারাও নানাভাবে ভয়ভিতী দেখায় এবং বলেন এই বিষয় নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন সাংবাদিক না ঢোকার ঘোষনাও দেন তারা।
সোনাতলা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় বর্তমান নাম (সরকারি সোনাতলা মডেল স্কুল ও কলেজ) উত্তরাঞ্চলের বিদ্যাপিঠগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সদ্য বিদায়ী প্রধান শিক্ষক মতিয়ার রহমানের পূর্ববর্তী সময়ে যারা এখানে প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন তারা কখনোই অর্থ তছরুপ করাতো দুরের কথা এধরনের চিন্তাও করেননি। কিন্তু মতিয়ার রহমান যোগদানের পর থেকেই এখানে অর্থ চুরির অভয়নগরে পরিনত হয়। এই চুরি কান্ডে প্রতিষ্ঠানের কিছু সহকারী শিক্ষক ও অফিস সহকারী সহযোগিতা করার জন্যও মেতে ওঠেন। কারন তারাও এই অর্থের মোটা অংকের ভাগ পেতেন। এই চুরিকান্ড অধরাই থেকে যাবে এমন চিন্তা মাথায় নিয়েই শেষ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ টাকা মেরে দেয়ার ফন্দি তৈরি করেছিল মতিয়ার রহমানসহ তার সহযোগিরা। ইতিপূর্বে মতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। তবে অর্থের কাছে ঐসব অভিযোগগুলো ধামাচাপা পরে গেছে বলে ধারনা স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের। অভিযোগগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালে অত্র প্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডির নির্বাচিত মহিলা সদস্য কুলসুম বেগম ৬ লক্ষ টাকা আত্মসাতের ব্যপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও উপ-সচিব বরাবর একটি অভিযোগপত্র দায়ের করেন। কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে তা ধামাচাপা পরে যায়। এ বিষয়ে কুলসুমের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমি অভিযোগ করেছিলাম কিন্তু পরবর্তীতে নেতা নেত্রীদের চাপে অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি। তিনি আরো বলেন, এই প্রধান শিক্ষক একজন দুর্নীতিবাজ শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে অসংখ্যা অভিযোগ আছে। এসব থেকে যদি বের হয়ে না আসা যায় তাহলে এই সুনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি রসাতলে চলে যাবে।
এই সংবাদের অনুসন্ধানের খোজে প্রায় ১ মাসের প্রচেষ্টায় উঠে আসে নানা ধরনের অনিয়মের তথ্য। এক পর্যায়ে দেখা যায় অর্থ তছরুপের ফিরিস্তি। অত্র প্রতিষ্ঠানের হিসাব দেখতে গিয়ে দেখা মেলে ইক্সিম ব্যাংক সোনাতলা শাখা হতে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারী ৪,৮৩,৪৪৮ টাকা উত্তোলন করেন, একই দিন ইসলামী ব্যাংক সোনাতলা শাখা হতে ৩,৩১,৫০০ টাকা, ৫ ফেব্রুয়ারী এক্সিম ব্যাংক হতে ৩,৪৪,৫৭১ টাকা, ২২ ফেব্রুয়ারী ১ লক্ষ টাকা, ৭ই মার্চ ৩,৯১,৫২৯ টাকা, ২১ মার্চ ৪৮ হাজার টাকা, ৯ এপ্রিল ৩,৪০,৬১০ টাকা, ১৮ এপ্রিল অগ্রণী ব্যাংক সোনাতলা শাখা হতে ১ লক্ষ টাকা, ১৮ মে ইসলামী ব্যাংক হতে ১,৪৮,৯৫৮ টাকা, ৭ জুন ইসলামী ব্যাংক হতে ২,১৭,২৮৯ টাকা, ১৪ জুন এক্সিম ব্যাংক হতে ১ লক্ষ টাকা, ৫ জুলাই এক্সিম ব্যাংক হতে ৩,৫৩,৪৫৩ টাকা, ১৭ জুলাই এক্সিম ব্যাংক হতে ২,৪৫,০০০ টাকা উল্লেখ্য ব্যাংক ষ্টেটমেন্টে দেখা যায় উল্লেখিত অর্থ অধ্যক্ষ মতিয়ার রহমান উত্তোলন করেছেন। এছাড়া ২ আগষ্ট এক্সিম ব্যাংক হতে ৩৮,৫১০ টাকা, ৬ আগষ্ঠ এক্সিম ব্যাংক হতে ১,৯০,৮০০ টাকা, ২২ আগষ্ট অগ্রণী ব্যাংক হতে ৫০,০০০ টাকা, ২৩ আগষ্ট অগ্রণী ব্যাংক হতে ৭৪,০০০ টাকা, ২৭ আগষ্ট ইসলামী ব্যাংক হতে ৪,৪৯,০০০ টাকা ও ২৮ আগষ্ট অগ্রণী ব্যাংক হতে ৫০,০০০ টাকা উত্তোলন করা হয়। উল্লেখিত অর্থের মোট অংক ৪০,১১,৯৯৫ টাকা।
অর্থাৎ খোজ নিয়ে অত্র প্রতিষ্ঠানের ব্যায়ের হিসাবে দেখা যায় প্রতি মাসে শিক্ষক/কর্মচারী খন্ডকালীনদের বেতন ৪৫,০০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল বাবদ আনুমানিক ৩,৫০০ টাকা, ইন্টারনেট বিল ১৫০০ টাকা, আপ্যায়ন বাবদ ৫,০০০ টাকা ও অন্যান্য ৫,০০০ টাকাসহ মোট ৬০ হাজার টাকা ব্যায় হয়ে থাকে।
এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে শিক্ষক কর্মচারীদের কোয়ার্টারে বসবাস থাকলেও তা খালি অবস্থায় থাকা দেখানো হয়েছে। কিন্তু এসবে বসবাসরতদের কাছে থেকে উত্তেলানকৃত অর্থ অভিযুক্ত মতিয়ার রহমান তার নিজ পকেটে ভরেন। এছাড়া ছাত্র ভর্তির সেশন চার্জ আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা অনুসরন করা হয়না। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিসাব রেজিষ্টার ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কথা থাকলেও এখানে স্কুল ও কলেজ শাখার হিসাব রেজিষ্টার একত্রেই করা হয়েছে। এসব নানাবিধ কারনে অত্র প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ অর্থের লোভে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আর কোন খেয়াল নেই প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ কিছু অসাধু শিক্ষক ও কর্মচারীদের।
এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে অস্বচ্ছ নিয়োগ বানিয্যের অভিযোগ অর্থাৎ মোটা অংকের টাকা, রাজনৈতিক পরিচয়, স্বজনপ্রীতি, সুযোগের সদব্যবহার, ক্ষমতার দাপটসহ নানাবিধ কারনেই চাকরি পেয়েছে বেশকিছু অদক্ষ ও অস্বচ্ছ শিক্ষক। যার কারনে বিগত দিনের তুলনায় ধিরে ধিরে শিক্ষার মানের হার কমেছে। যার ফল স্বরুপ দেখা যায় প্রতিবছর বার্ষিক, এস এস সি ও এইচ এসসি পরিক্ষার ফলাফল নিম্নমুখী হয়েছে। অত্র পতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের পরিচয় জানতে গেলে দেখা যায় শিক্ষকতার পাশাপাশি বর্তমানেও তারা রাজনৈতিক পদ-পদবিতে বহাল রয়েছেন।
অভিযুক্ত মতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, সে নিয়োগবোর্ডের সদস্য সচিব থাকা অবস্থায় তার স্ত্রী মোঃ মোকছেদা বানুকে নিয়োগ দেয়া হয় কিন্তু নিয়মানুসারে নিয়োগবোর্ডের সদস্য সচিবের স্ত্রী কোনভাবেই নিয়োগ পাবার কথা নয়।
বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের এক পর্যায়ে অত্র প্রতিষ্ঠানে পৌছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান অধ্যক্ষ জিএম আহসান হাবিব ও সহকারী শিক্ষক মোঃ মানিক মিয়া বলেন, আমরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এসব তথ্য দিতে পারবোনা। কর্তৃপক্ষ কারা জানতে চাইলে তারা বলেন ডিজি মহাদয়। এসময় বর্তমান অধ্যক্ষ জিএম আহসান হাবিব বলেন আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি তাই এসব হিসাব আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। আর অনিয়ম যদি হয়ে থাকে তাহলে এসব করেছে আমার পূর্বের অধ্যক্ষ সাহেব এবং তার সাথে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তাগন। কারন তার স্বাক্ষর ছাড়া টাকা উত্তোলন করা সম্ভব নয়। এসময় মোঃ মানিক মিয়া বলেন আমাদের প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি আমরাই দেখবো। বাহিরের কাউকে এর হিসাব দেখাবোনা।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক (অধ্যক্ষ) মোঃ মতিয়ার রহমান বলেন আমি কোন দূর্নীতি করিনি এসব অর্থ উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানের কাজ করেছি। কি ধরনের কাজ করা হয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন যেহেতু আমি ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে চলে এসেছি তাই বিগত দিনের তথ্য আমার পক্ষে দেয়া এবং বলা সম্ভব নয়। এসব তথ্য বর্তমান প্রধান শিক্ষক দেবেন।
প্রসংগত, গোপন সংবাদে জানা যায় অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধায় অত্র প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে প্রায় ২৪ ঘন্টা সময় সেখানে অবস্থান করে শুক্রবার গভির রাতে কক্ষ ত্যাগ করে। পুনরায় শনিবার সকাল ৯ টায় প্রবেশ করলে স্থানীয় সাংবাদিকরা খবর পেয়ে বিকেল ৪টার দিকে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখতে পায় অভিযুক্ত মতিয়ার রহগমান ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক জিএম আহসান হাবিবসহ কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারী বের হয়ে যাচ্ছেন।
এসময় শনিবারে কি কাজ করা হল জানতে চাইলে মতিয়ার রহমান দ্রুত স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করে। এসময় ছুটির দিনে বিদ্যালয়ে কেনো আসা হয়েছে জানাতে চাইলে মতিয়ার রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই বলবোনা। স্থান ত্যাগ করার সময় মতিয়ার রহমানের হাতে একটি কালো বড় ব্যগ ছিল ঐ ব্যাগে কি আছে, তা দেখাতে রাজি হয়নি সে। এসব ঘটনায় স্থানীয়দের মনে সন্দেহ আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন। এই বিষয়ে আমি মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে ছোটখাটো কিছু অনিয়ম হয়েই থাকে তাতে ঘাবরালে চলবেনা। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্থানীয় সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন যে, তাদের সাথে নানা ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরন করেছেন। এছাড়াও সাংবাদিকদেরকে নানাভাবে ভয়ভীতিও দেখান তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাবেয়া আসফার সায়মার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক একাউন্টে ৪০ লক্ষ টাকা থাকবে এটা কল্পনাতীত। তিনি জোর দিয়ে বলেন এই প্রতিষ্ঠানে কখনোই ৪০ লক্ষ টাকা ছিলনা। এ সময় ব্যাংক ষ্টেটমেন্টে এমন এমাউন্ট উল্লেখ আছে বললে তিনি বলেন ঐ ব্যাংক ষ্টেটমেন্টটাও ভূয়া হতে পারে। কারন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক একাউন্টে এতো পরিমান টাকা থাকার কোন সুযোগ নেই।
বিষয়টি বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামকে অবগত করলে তিনি বলেন আমি এই বিষয়টি জানিনা। তবে সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বগুড়া জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে থেকে বিষয়টি জেনে তদন্ত সাপেক্ষ দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অত্র প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক বলেন এই প্রধান শিক্ষক যোগদানের পর থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থা একেবারেই বেহাল দশা করে ফেলেছে। আবার যে প্রধান শিক্ষক বর্তমানে দায়িত্ব নিয়েছে তারও একই অবস্থা অর্থাৎ এখান থেকে বের হয়ে আসা খুবিই দুস্কর। অতিসত্তর উর্ধতন কর্তৃপক্ষে হস্তক্ষেপ না হলে প্রতিষ্ঠানটি রসাতলে চলে যাবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের অর্থের ভাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছেও যায় তাই এসবে তদন্ত কমিটি করে কোন লাভ হয়না।