যশোরে করোনা সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। সংক্রমণের হারে খুলনা বিভাগের দশ জেলার মধ্যে যশোর শীর্ষে রয়েছে। উপসর্গ ধারণকারীদের অর্ধেকের শরীরে এ ভাইরাস ধরা পড়েছে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩১৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে নতুন করে আরও ১০৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ৩৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এছাড়া যবিপ্রবির ল্যাবে যশোরের ৩১৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১০৯ জনের করোনা পজেটিভ এবং ২০৬ জনের নেগেটিভ ফলাফল এসেছে। সোমবার এ শনাক্তের হার ছিল ৫১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মোট ৩৭৯ জনের করোনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ১৯৫ জন। এর আগে রোববার যবিপ্রবি’র জিনোম সেন্টারের গবেষণায় ৩৫ জনের শরীরে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ধরা পড়ে ও ১২ জানুয়ারি ভারত থেকে আসা ৩ জনের পরীক্ষায় ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছিল। যশোরে শনাক্ত হওয়া মোট ওমিক্রনধারীদের সংখ্যা ৩৮ জন ও নতুন করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টধারীদের সংখ্যা ৬ জন।
গত ১২ জানুয়ারি যশোরকে ইয়েলো জোনের আওতায় রাখা হলেও সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯ জানুয়ারি রেড জোনের আওতায় আনা হয়। সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরে না। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই হাটবাজার ও গণজমায়েতপূর্ণ স্থানে অবাধে বিচরণ করছে। মূলত এ জন্যই বাড়ছে সংক্রমণ।
এদিকে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করে ২১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতার তেমন কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বলতে গেলে স্বাস্থ্যবিধি উধাও। অবশ্য, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মাস্ক বিতরণ ও প্রয়োজন অনুসারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এরপরও অধিকাংশ মানুষের মুখে রাস্তাঘাটে মাস্ক দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যশোরের বেনাপোলে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল পোর্ট। এ ছাড়া যশোরে বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন এবং দেশের ১৮টি জেলায় চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসের বড় টার্মিনাল রয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এখানে ব্যাপক মানুষের সমাগম ঘটে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন খুব দ্রুত ছড়ায়। এ জন্য মানুষজন বেশি সংক্রমিত হচ্ছে। আর যেহেতু শনাক্তের হার অনেক বেশি সেই কারণে যশোরকে উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনায় দেশে চারমাসের খানিকটা বিরতির পর জানুয়ারি থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে এ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যশোরে প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। বর্তমানে সংক্রমণের হারে খুলনা বিভাগের দশ জেলার মধ্যে যশোর শীর্ষে রয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। ইতিমধ্যে যশোরে চলতি মাসেই ৩৮ জনের করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। মানুষের মাঝে সচেতনতাবোধ না থাকা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে।
যদিও সংক্রমণ মোকাবেলায় যশোর স্বাস্থ্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বেড়েই চলেছে সংক্রমন।
নতুন করে করোনা শনাক্তদের মধ্যে সদর উপজেলা এলাকায় ১৪৯ জন, ঝিকরগাছায় ২৪ জন, চৌগাছায় ৬ জন, মণিরামপুরে ৪ জন, অভয়নগরে ১ জন ও শার্শায় ১১ জন রয়েছেন। এ হিসেবে যশোর জেলায় মোট শনাক্তের সংখ্যা দাড়িয়েছে ২২ হাজার ৮১৯ জন, সুস্থ হয়েছেন ২১ হাজার ৪৩৪ জন। বর্তমানে জেরারেল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১৩ জন। চলতি বছরে করোনায় নতুন করে কোন মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৫১৭ জন।
এসব ব্যাপারে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনোম সেন্টারে করোনা গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ডক্টর ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, যবিপ্রবির গবেষকদল করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রন নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই তারা করোনা পরীক্ষার সন্দেহজনক উপাদানগুলো সংরক্ষণ করছে ও দাতাদের সাথে কথা বলে গোটা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, যবিপ্রবিতে করোনা পরীক্ষায় প্রতিদিনই শনাক্তের হার বাড়ছে। অনেকে ভাবছেন টিকা দেওয়া আছে, তাই আর করোনা সংক্রমণের ভয় নেই।
এ বিষয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, মূলত জন-অসচেতনতার কারণেই আমাদের জেলায় সংক্রমণের হার বাড়ছে। এই জেলাতে বহু মানুষের চলাচল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার মানুষের চলাচল এই জেলার ওপর দিয়ে বেশি। বেনাপোল বন্দর থাকায় প্রতিনিয়ত হাজার হাজার পরিবহন চলাচল করে। ভারত থেকে প্রচুর মানুষ যাতায়াতসহ পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধে আমরা আগের মতোই কাজ করে যাচ্ছি। তবে, এবার একটু বেশি সতর্ক রয়েছি। হাসপাতালে আমাদের রেড জোন এবং ইয়েলো জোনে বেড রয়েছে যথাক্রমে ৪৬ ও ৩০। তার বিপরীতে রোগী ভর্তি রয়েছে যথাক্রমে ৯ ও ২০ জন।
হাসপাতালে মূলত আমরা তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছি। সেগুলো হচ্ছে- রোগীদের বেড, ক্রিটিক্যাল রোগীদের আইসিইউ এবং অক্সিজেন ফ্লো। এখন পর্যন্ত আমাদের বেড, অক্সিজেন ও আইসিইউর কোনও সমস্যা নেই। হাসপাতালে ৫২৫টি ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৪১টি বড় সিলিন্ডার এবং ৫ হাজার ৬৪৮ ঘণ লিটার অক্সিজেন প্ল্যান্ট রয়েছে।
ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, আমাদের লোকবলের কিছুটা সমস্যা রয়েছে। আমরা বড় ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে ২০ জন চিকিৎসক, ২০ নার্স, ১৫ কর্মচারী ও ১৫ জন নৈশপ্রহরীর চাহিদা জানিয়ে পত্র দিয়েছি।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং জনসচেনতা বৃদ্ধিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে হলে জানিয়েছেন যশোরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ শারবীন। তিনি বলেন, আমরা মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি যাদের প্রয়োজন তাদের মাস্ক সরবরাহ করছি। ইতোমধ্যে আমরা কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করেছি।
এদিকে, করোনার এই পরিস্থিতিতে যশোর জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির জুম মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলা প্রশাসক মো. তজিমুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে করোনার সংক্রমন ঠেকাতে আরও কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস জানান, করোনার সংক্রমণ রুখতে সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিতকরণ এবং শতভাগ ভ্যাকসিনেশনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিশেষ করে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে শতভাগ নাগরিককে টিকা প্রদানের (প্রথম ডোজ) আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য গোটা জেলায় ম্যাস ভ্যাকসিনেশনের কার্যক্রম চলছে। ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি যশোর ঈদগাহ ময়দানে গণটিকা প্রদান করা হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধনের কপি আনলেই তাকে টিকা প্রদান করা হবে। আমাদের টার্গেট ৩১ জানুয়ারির মধ্যে শতভাগ টিকা প্রদান নিশ্চিত করা। এছাড়া মাস্ক পরিধান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি প্রচারণার জন্য মাইকিং করা হবে। যাতে মানুষ আরও সচেতন হতে পারে। পাশাপাশি সরকারঘোষিত বিধি-বিধান অমান্য করলে শাস্তির জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও জোরদার করা হবে।