রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে বুধবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পর তৈরি হওয়া আন্তর্জাতিক প্রোপাগান্ডার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “আমরা যে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করেছি, তা মুছে দিয়ে পুরনো কাঠামোতে ফিরে যেতে একটি বিশেষ মহল চেষ্টা করছে। তারা সরাসরি মুখে কিছু বলছে না, তবে তাদের কার্যক্রম স্পষ্টতই সেই পুরনো ব্যবস্থাকে ভালো দেখানোর চেষ্টা।”
ড. ইউনূস অভিযোগ করেন, “বিশেষ শক্তিগুলো এমন এক ‘কল্পকাহিনী’ তৈরি করছে, যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কল্পকাহিনী মানুষকে বিভ্রান্ত করছে এবং আমাদের সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করছে। আমরা বারবার বলেছি, আসুন, দেখুন- এখানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তারা দূর থেকে গল্প বানিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রাপথে এটি অস্তিত্বের সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “বিশ্বের কাছে আমাদের বর্তমান বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সবাইকে একত্র হতে হবে। আমরা এক হয়ে যেটা অর্জন করেছি, তা কোনো মতবাদের জন্য নয়, বরং ঐক্যের মাধ্যমে। এটি আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে।”
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, “জাতীয় স্বার্থে আমাদের একজোট হতে হবে। বিভাজনের চেয়ে ঐক্য আমাদের মূল শক্তি। যারা দেশের অভ্যুত্থান পছন্দ করেনি, তারা এটাকে উল্টে দেওয়ার জন্য নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। এটি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বের বড় শক্তির মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।”
ড. ইউনূস রাজনৈতিক নেতাদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমাদের দেশে এখন কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের লড়াই নেই। এটি জাতি হিসেবে টিকে থাকার লড়াই। তাই সবাই মিলে একটি সমবেত শক্তি তৈরি করতে হবে। এই সমবেত শক্তির জন্যই আপনাদের সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে।”
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, “৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর থেকে বিভিন্ন মহল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা পালিত হয়েছে। আমরা পূজার আনন্দে শরিক হয়েছি। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। কিন্তু এ বিষয়টিও কিছু মহলের পছন্দ হয়নি।”
ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের যে অভ্যুত্থান, সেটা যাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটিকে নতুন করে কল্পিত ভঙ্গিতে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চায়। আমাদের দেশে নাকি ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে, এমন প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করার নামে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসব মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে।”
বিকেলে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। প্রধান উপদেষ্টা নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনারা ভালো বোঝেন যে, এক হয়ে কথা বললে একটি শক্তিশালী ঐক্যের বার্তা যায়। সেই বার্তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে।”
ড. ইউনূস দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “যে বাংলাদেশ আমরা গড়ার চেষ্টা করছি, সেটিকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারলেই আমরা প্রমাণ করতে পারব যে আমাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা শুধু সম্ভব নয়, এটি আমাদের জাতীয় গর্বের অংশ।”
এই বৈঠক থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের সুর আরও মজবুত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ড. ইউনূসের এই বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন দৃষ্টিকোণ উন্মোচন করেছে। তিনি জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যে আলোচনা শুরু করেছেন, তা ভবিষ্যতে দেশের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বায়ান্ন/পিএ