রাস্তার ধুলো আর যানজট মাড়িয়ে অনেকেই সড়কপথে ভ্রমণ করতে চান না। আরামদায়ক, নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ট্রেন যাতায়াত সবার পছন্দের বাহন।কিন্তু ট্রেনও এখন আতঙ্কের বাহনে পরিণত হচ্ছে। কতৃপক্ষের যথাযথ পর্যবেক্ষণ আর তদারকি না থাকাই সড়কপথের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ট্রেন দূর্ঘটনা।
এছাড়া কতৃপক্ষের পুকুর চুরি, তদারকির গাফেলতি ও মেয়াদোত্তীর্ণ সরঞ্জাম,ও দৃর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি না হওয়ায় বাড়ছে ট্রেন দুর্ঘটনা।
এছাড়া ট্রেন দুর্ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি করার কথা শোনা যায়, কিন্তু তদন্তের প্রতিবেদন এবং এর প্রেক্ষিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- তা অনেকটাই গোপন থাকে।
তদন্ত কমিটিগুলো এমনভাবে গঠন করা হয়, যাতে এই কমিটিতে যারা থাকে তারা তদন্তে একেবারে নিচের পর্যায়ের ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করে থাকে।ফলে উপরের পর্যায়ে যেসব কর্মকর্তা ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য প্রতক্ষ ও প্রকৃতভাবে দায়ী তারা সবসময় শাস্তির বাইরে রয়েই যান।
মূলতঃ ঝুঁকিপূর্ন লেভেলক্রসিং, মেয়াদোত্তীর্ণ রেল লাইন ও সেতু ট্রেন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। প্রতিদিন তিনবার করে পুরো রেললাইন, সিগন্যাল ও সেতু পরিদর্শনের কথা থাকলেও অনেক সময় বছরে একবারও পরিদর্শন করা হয় না।
রেললাইনে পাথর না থাকা, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি, লাইন ক্ষয়, স্লিপার নষ্ট, লাইন ও স্লিপার সংযোগস্থলে লোহার হুক না থাকার কারণেও ঘটছে ট্রেন দুর্ঘটনা।
লাইনে নির্ধারিত দূরত্বের মধ্যে (প্রায় ৪০-৫০ ফুট) পয়েন্ট রয়েছে। এসব পয়েন্টের মধ্যে দুইপাশে ৮টি করে মোট ১৬টি নাট-বল্টুসহ ১৬টি হুক, ক্লিপ থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ পয়েন্টের মধ্যে ১৬টির স্থলে রয়েছে ৫-৭টি ।
সারা দেশে ৩ হাজার ৬টি রেল সেতুর মধ্যে ৯০ শতাংশ তৈরি ব্রিটিশ আমলে। জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে সেতুগুলো। এগুলোর ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিভিন্ন রুটের ট্রেন।ব্রিটিশ আমলের নির্মিত মেয়াদোত্তীর্ণ রেলসেতু, ইঞ্জিন, কোচ, জরাজীর্ণ রেললাইন ও লোকবলের অভাবও ট্রনদূর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
দেশের প্রায় ৩ হাজার ৩৩২ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময় খোলা থাকে ফিশপ্লেট, ক্লিপ, হুক, নাট-বল্টুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। এমনকি রেললাইন মজবুত ও স্থিতিশীল রাখতে স্থাপিত স্লিপারগুলোর অবস্থাও নাজুক। আবার এসব স্লিপারকে যথাস্থানে রাখতে যে পরিমাণ পাথর থাকা প্রয়োজন অধিকাংশ স্থানে তা নেই। আবার কোন কোন স্থান পাথরশূন্য।
কতৃপক্ষের তদারকির অভাব :-
ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে কোনও তদারকি নেই রেলওয়ের। রেললাইনে পাথর দেওয়ার পর সেগুলো আর তদারকি হয়না। লম্বা ধাতব রেললাইন খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে ঝড়-বৃষ্টি গরম-ঠাণ্ডা সহ্য করে। রেললাইন গরমে বেড়ে যাওয়া এবং ঠাণ্ডায় আয়তনে কমে যাওয়া থেকে রক্ষা করে পাথর। বিশাল মাপের ট্রেন রেললাইন দিয়ে যাওয়ার সময়ে মাটিতে কম্পন শুরু হয়। কম্পনে রেললাইনকে এক জায়গায় রাখতে এই পাথর ব্যবহার করা হয়। পাথর থাকার ফলে রেললাইনে আগাছা জন্মাতে পারে না। আগাছা জন্ম নিলে ট্রেন চালাতে অসুবিধা হয়। অথচ তদারকির অভাবে বেশিরভাগ পাথর চুরি হয়ে যায়। আবার এখন যেসব পাথর দেওয়া হয়, তা নিম্নমানের। এতে নড়বড়ে হয়ে যায় রেললাইন।
এছাড়া রেললাইনের ক্লিপ-হুক, নাটবল্টু চুরি, স্লিপার পচে যাওয়া, স্লিপারের হুক উঠে আসা, লাইনের নিচের মাটি ও পাথর সরে যাওয়ার ফলে ট্রেনের লাইনচ্যুতিও নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলপথের ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় ট্রেনের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হচ্ছে। রেলপথে প্রতি ১০০ গজে পাহারা থাকার কথা থাকলেও অনেক স্থানেই তা নেই। সন্ধ্যার পর অনেক এলাকা নেশাখোর, বখাটে ও চোরদের আড্ডাস্থল হয়ে পড়ে। এরাই রাতে রেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরি করে বিক্রি করছে। রেললাইনের পাশে বস্তি, কাঁচাবাজার বসানোর ফলেও ঘটছে দুর্ঘটনা।
এছাড়া প্রতিদিন রেল লাইন, সিগন্যাল ও ব্রিজ পরিদর্শন করা ছাড়াও ট্রেন ছাড়ার পূর্বে ইঞ্জিন ও প্রতিটি বগির বিশেষ বিশেষ যন্ত্রাংশ এবং চাকা চেক করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন আমদানী:-
মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের কারণেও দুর্ঘটনায় পড়ছে ট্রেন। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেন থেকে ১০টি নিম্নমানের ইঞ্জিন এনে সমালোচনার মুখে পড়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সেই সমালোচনার তোয়াক্কা না করেই গত ২১ নভেম্বর আরও ১০টি ইঞ্জিন একই কোম্পানি থেকে আমদানি করে রেলওয়ে। সেই নতুন ইঞ্জিনগুলো বহরে যুক্ত হতে না হতেই ৩টি ইঞ্জিন অকেজো হয়ে গেছে।
যাত্রীদের লাফালাফি করে ট্রনে উঠা:-
ট্রেনের ছাদে উঠে কিংবা এক বগি থেকে অন্য বগিতে লাফিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় নিচে পড়ে কাটা পড়ে মারা যায় অনেক পথশিশু ও ভবঘুরেদের।
অসচেতনতা:-
সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অধিকাংশই ঘটেছে রেল লাইন পারাপারের সময় অসচেতনতার কারণে। অবহেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে লোকের মৃত্যুও বাড়ছে। ট্রেন আসার সময়েই রেল লাইন পারাপার হতে চায় মানুষ। সামান্য অবহেলার কারণে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে হয়। ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে, মোবাইলে কথা বলা অবস্থায় এবং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়েও প্রাণ দিতে হচ্ছে।
প্রতি মাসেই রেললাইন এলাকা থেকে উদ্ধার হচ্ছে মরদেহ। কখনও ট্রেনে কাটা পড়ে মরছে মানুষ, কখনও ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে। আবার কখনও মৃত্যুর কারণ থাকে অজ্ঞাত। রেললাইনের পাশে পড়ে থাকে মৃতদেহ। রেলওয়ে পুলিশের তথ্যানুযায়ী বছরে তিন শতাধিক মরদেহ উদ্ধার হয় রেললাইন থেকে, যার বেশিরভাগই দুর্ঘটনা বলে প্রমাণিত ।