ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মূলধনে টান ১৫ ব্যাংকের

বায়ান্ন ডেস্ক : | প্রকাশের সময় : রবিবার ৮ অক্টোবর ২০২৩ ১১:৪৭:০০ অপরাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

দেশের ১৫টি ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব ব্যাংক ঋণের মান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। প্রভিশন রাখতে গিয়ে তারা মূলধনে টান দিচ্ছে, আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণে মূলধনও রাখতে পারছে না। এসব ব্যাংক এরই মধ্যে নিজেদের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার মূলধন খেয়ে ফেলেছে।

 

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। ওই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়। যথাসময়ে ঋণ আদায় করতে না পারলে খেলাপি বা মন্দ ঋণে পরিণত হয়। নিয়ম অনুযায়ী ঋণ খারাপ হয়ে পড়লে অনুপাতহারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) ও অতিরিক্ত মূলধন রাখতে হয়, যার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। 

 

কিন্তু ১৫টি ব্যাংক সেই অনুপাতে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এগুলো হলো— রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংক; বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক; বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।

 

এটা উদ্বেগজনক অবস্থা, ব্যাংক খাত যে খারাপের দিকে যাচ্ছে এ চিত্র তাই বলে দিচ্ছে। খেলাপি ঋণ বাড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে-

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর

 

ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির পর এখন পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে তাদের মূলধন সংকট চলছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও বেশি সুদে তহবিল নিয়ে কম সুদে ঋণ দেওয়ার কারণে ঘাটতিতে পড়েছে। অন্যদিকে অনিয়ম-জালিয়াতির কারণে বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।  

 

কোন ব্যাংকের কত ঘাটতি

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১০ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা, বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের ১৭ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা, বেসরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের পাঁচ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা এবং বিদেশি খাতের দুই ব্যাংকের মূলধন সংকট রয়েছে ৭৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

 

 

২০২৩ সালের জুন শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, তাদের মূলধন থাকার কথা ছিল ৩ হাজার ৯শ কোটি টাকা (প্রায়)। একইভাবে বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংকের ১০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি ১৫ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ২ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা।

 

সরকারি ব্যাংকগুলোর সবগুলো মিলে মূলধন থাকার কথা ছিল ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। তারা মূলধন রেখেছে ৯ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। একমাত্র ব্যতিক্রম বিডিবিএল, এই ব্যাংকটির কোনো মূলধন ঘাটতি নেই।

 

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৮৮ কোটি টাকা, সিটিজেন ব্যাংকের ৯৭ কোটি ১০ লাখ টাকা, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। সাবেক ফারমার্স বা বর্তমান পদ্মা ব্যাংকের ঘাটতি ৪৯৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

 

এছাড়া বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ঘাটতি ৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। 

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২২ অনুসারে, দেশের ব্যাংকগুলো গত বছর মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (সিএআর) ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ ধরে রেখেছে। যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। পাকিস্তানের ব্যাংকগুলোর এই অনুপাত ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ, ভারতের ১৬ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। 

 

‘দুর্বল ব্যাংক’ ঘোষণা দিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে

 

ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা উদ্বেগজনক অবস্থা, ব্যাংক খাত যে খারাপের দিকে যাচ্ছে এ চিত্র তাই বলে দিচ্ছে। খেলাপি ঋণ বাড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

 

ড. মনসুর বলেন, মূলধন ঘাটতি কমাতে হলে পলিসি অনুযায়ী এগোতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোরজন্য এক পলিসি হবে, যা পালন করবে সরকার আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য এক পলিসি হবে যার দায়িত্ব নেবে তাদের পর্ষদ।

 

যেসব ব্যাংক নীতি অনুযায়ী মূলধন সংক্ষণ করতে পারবে না তাদেরকে ‘দুর্বল ব্যাংক’ হিসেবে একীভূত করে দিতে হবে। তা না হলে বছরের পর বছর ঘাটতি বাড়তেই থাকবে।     

 

মূলধন সংরক্ষণের নিয়ম

 

সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে ব্যাংকগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন (ক্যাপিটাল) রাখতে হয়। এর বাইরে কোনো ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে সেটিতে মূলধনও বেশি রাখতে হয়।

 

ব্যাংক মূলধন হিসাবায়ন করে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে। বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি প্রকৃতি সামনে রেখে মূলধন রাখার বিভিন্ন নিয়ম ঠিক করে ‘ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট (বিআইএস)’। বিআইএসের নিয়মকে ব্যাসেল গাইডলাইন্স হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। 

 

বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো এখন মূলধন সংরক্ষণ করার যে নিয়ম অনুসরণ করছে তাকে ‘ব্যাসেল-৩’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। 

 

ব্যাসেল গাইডলাইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদও বাড়ে। ঋণের মান অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নির্ণয় করা হয়। ভালো ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ কম হিসাব করা হয়। আবার খারাপ বা খেলাপি ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ধরনের সম্পদকে কেন্দ্র করে কোনো ব্যাংক কী পরিমাণ মূলধন রাখবে তা নির্ণয় করা হয়।

 

ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী যেকোনো ধরনের ঝুঁকি এড়াতে একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। এর সঙ্গে আপৎকালীন সুরক্ষা মূলধন (ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার-সিসিবি) হিসেবে আরও আড়াই শতাংশ মূলধন রাখার বিধান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী যে ব্যাংকের খেলাপি বা মন্দ ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয়।

 

দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের চিত্র

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কেবল সবশেষ ৩ মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।