ঢাকা, সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পাবনায় দেড় মাসে ৮ খুন: আইন শৃঙ্খলার অবনতিতে উৎকণ্ঠা

পলাশ হোসেন, পাবনা | প্রকাশের সময় : সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:১২:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

হঠাৎ করেই হত্যাকান্ড বাড়ছে উত্তরের জেলা পাবনায়। গত দেড় মাসে জেলায় ঘটেছে ৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। যার মধ্যে নভেম্বর মাসের ২৪ দিনে ছয়টি হত্যাকান্ড ঘটেছে। আর অক্টোবর মাসে ঘটেছে দু'টি। তবে একটি মৃত্যু নিয়ে পুলিশ এখনও সন্দিহান হত্যা নাকি অপমৃত্যু। তবে সম্প্রতি দুই দিনের ব্যবধানে ঘটেছে তিনটি হত্যার ঘটনা।

এসব হত্যাকান্ড ছাড়াও বেড়েছে ছিনতাই, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, লুটপাট, অপমৃত্যুসহ নানা অপরাধ। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতিতে জনমনে ভর করছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। ৫ আগস্টের পর পুলিশ এখনও পুরোপুরি মাঠে সক্রিয় না থাকার সুযোগে অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

জেলা পুলিশ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ নভেম্বর সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের মাছের খামারে যাচ্ছিলেন পাবনা সদর উপজেলা মৎসজীবি দলের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক জালাল উদ্দিন (৪৫)। পথিমধ্যে বেতেপাড়া মোড়ে পৌঁছালে হেমায়েতপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সদস্য মুন্তাজ আলী এবং তাদের লোকজন জালালকে কুপিয়ে হত্যা করে।

পরদিন ১৭ নভেম্বর রাতে পাবনা শহরে তুষার হোসেন (১৬) নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সে ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর স্কুলছাত্র সিয়াম হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিল তুষার।

তারপর দিন ১৮ নভেম্বর সকালে ঈশ্বরদীর রূপপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে ওয়ালিফ হোসেন মানিক (৩৫) নামের এক যুবলীগ কর্মীকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০২৩ সালের ১৭ জুন ছাত্রলীগ কর্মী তাফসির আহম্মেদ মনা হত্যা মামলার আসামী ছিলেন তিনি। জামিনে বের হয়ে প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারান মানিক।

২৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তের হাতে খুন হন বাকুল মিয়া (৪৫)। চরমপন্থী জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনের ফিরেও শেষ রক্ষা হলো না তার।

এছাড়া গত ৮ নভেম্বর সকালে আতাইকুলা থানার গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে আসিফ হোসেন (৩২) নামের মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের গলা কাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আগেরদিন ৭ নভেম্বর রাতে এলাকায় একটি জালসা শুনে বাড়ি ফেরার পথে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি।

২৯ অক্টোবর বিকেলে নিখোঁজ হয়েছিলেন আতাইকুলার ভ্যানচালক রবিউল ইসলাম (৪৫)। চারদিন পর ১ নভেম্বর সকালে তার মরদেহ তৈলকুপি গ্রামের একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যার পর তার ভ্যানটি নিয়ে লাশ গুম করার জন্য পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়।

অপরদিকে গত ১০ অক্টোবর সকালে ঈশ্বরদীতে লিচু বাগান থেকে নয়ন হোসেন (২৮) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক ছিলেন। নিহত নয়নের মুখমণ্ডল ও গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখে  পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, চাকু দিয়ে খুঁচিয়ে এবং শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয় তাকে।

এসব হত্যাকান্ড ছাড়াও গত ৩০ অক্টোবর সুজানগরের নাজিরগঞ্জ ফেরীঘাট এলাকার পদ্মা নদী থেকে মুকুল হোসেন (৪০) নামে এক পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মুকুল হোসেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার এএসআই ছিলেন।

৩১ অক্টোবর সকালে সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়ার সিংহনগর স্কুলের সামনে পদ্মা নদীর তীরে ১২ বছরের এক কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ১ নভেম্বর বিকেলে একই উপজেলার সাতবাড়িয়ার কাঞ্চন পার্কের সামনে ভাসমান অবস্থায় ২২ বছরের এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি।

রাজনৈতিক বিরোধের বলি হেমায়েতপুরের জালাল উদ্দিনকে হারিয়ে দিশেহারা স্বজনরা। এ বিষয়ে নিহত জালালের স্ত্রী সালমা খাতুনের অভিযোগ, ’স্থানীয় কবরস্থানের কমিটি গঠন নিয়ে জালালের উপর ক্ষুব্ধ হয় মুন্তাজ ও তার লোকজন। কমিটিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রাধান্য দিয়ছিলেন জালাল, মুন্তাজের কথা শোনেননি। সেই ক্ষোভের আগুনে প্রাণ দিতে হলো তাকে। হত্যাকান্ডের পর মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন জালালের ছেলে লাবু হোসেন। জতিদের ফাঁসির দাবি জানান তিনি।’

কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ায় আতংকে থাকতেন নিহত তুষারের মা তাসলিমা খাতুন। তাকে ফেরানোর চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি একমাত্র ছেলেকে। তিনি বলেন, ‘সিয়াম হত্যার সময় তার ছেলে তুষার বন্ধুদের সাথে গিয়েছিল। ওই সময় মারামারিতে রক্তাক্ত হয়েছিল তুষার। পুলিশ তাকে সেই অবস্থায় গ্রেপ্তার করায় হয়ে যায় এক নাম্বার আসামি। কিন্তু তার ছেলে হত্যা করেনি বলে দাবি করেন।’

তুষারের বোন আশা খাতুন বলেন, ‘আমার ভাই হত্যার সাথে জড়িত কি না, বা সেই হত্যা করেছে তা প্রমাণ হবে আদালতে। আইনে তার বিচার হবে। তাই বলে হত্যার বদলে হত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানান তিনি।’

শুধু জালাল, তুষার বা মানিক-ই নয়। গত দেড় মাসে পাবনা জেলায় মোট হত্যাকান্ড ঘটেছে সাতটি। এর মধ্যে অক্টোবর মাসে দু’টি আর নভেম্বর মাসের প্রথম পনেরদিনেই ঘটেছে ৫টি হত্যাকান্ড। এর মধ্যে একটি মৃত্যু মামলা নিয়ে সন্দিহান পুলিশ। হত্যা না অপমৃত্যু সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এছাড়াও রয়েছে বেশকিছু অপমৃত্যু, ছিনতাই, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও সংঘর্ষের মতো নানা অপরাধমুলক ঘটনা। বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়র দৌড়াত্ম ও মাদক ব্যবসা। এসব ঘটনায় উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় সাধারণ মানুষ।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) পাবনার সভাপতি আব্দুল মতীন খাঁন মনে করেন, ’৫ আগস্টের পর পুলিশ প্রশাসন এখনও মাঠে পুরোপুরি সক্রিয় না থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। যখন অপরাধীর বিচার হবে না, তখন অন্য অপরাধীরা আরো উৎসাহি হবে। প্রশাসন এখনই লাগান টেনে না ধরলে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রেজিনূর রহমান বলেন, ’অতীতের রেকর্ড যদি আমরা পর্যালোচনা করে দেখা যায় পাবনা জেলায় প্রতিমাসে সাধারণত ৪ থেকে ৫টি হত্যা মামলা হয়ে থাকে। চলতি নভেম্বর মাসে ৫টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৪টি হত্যা মামলা হয়েছে। আর একটি মৃত্যুর মামলা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসলে বোঝা যাবে সেটি হত্যা নাকি অপমৃত্যু। সেটি সন্দেহজনক হিসেবে আছে। ইতিমধ্যে প্রায় সবগুলো মামলার রহস্য উদঘাটন হয়েছে এবং অনেক আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

রেজিনূর রহমান আরো বলেন, 'প্রতিমাসে পাবনা জেলার মামলা পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝায় যায় এগুলো স্বাভাবিক একটি বিষয়। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পুলিশের উপর আস্থা রাখুন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সঙ্কট কাটিয়ে পুলিশ আরো বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মানুষের আস্থা হারানোর এখানেই কিছু নাই।'

জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে পাবনায় সাতটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ৬০ জন। আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১ জনকে। বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড পূর্ববিরোধ, রাজনৈতিক বিরোধ ও প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ঘটেছে।

বায়ান্ন/প্রতিনিধি/একে