চাঁদপুর - শরীয়তপুর জেলার মধ্যে মেঘনা নদীর দূরত্ব নদীপথে ১০ কিলোমিটার। এখানেই মেঘনা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার।এজন্য শুরু হয়েছে সম্ভাব্যতা যাচাই। কয়েক ধাপে হয় একই কাজটি।গত মে মাস জুড়েই শরীয়তপুর ও চাঁদপুর অংশে নদীর মাঝখানে এবং উপকূলে সমীক্ষা প্রকল্পের প্রকৌশলীরা মাটি ও ভূগর্ভস্থ অবস্থা নির্ণয় সম্পন্ন করেছেন। জুন মাসের ৩০ তারিখের মধ্যেই এ সমীক্ষা রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা ছিলো।এরপর অর্থ বরাদ্দ এবং সেতু নির্মাণে সরকার অগ্রসর হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন ঘুরে গতকাল বৃহস্পতিবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুর-চাঁদপুর জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা মেঘনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের পর সরকার একজন পরামর্শক নিয়োগ দেন। একই সঙ্গে সেতু নির্মাণের জন্য ‘মেঘনা সেতু সমীক্ষা প্রকল্পে’র আওতায় সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় গত মে মাসে। চলতি মাসের শুরুতেই সেই সমীক্ষা শেষ হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, মেঘনা নদীর চাঁদপুর অংশের বহরিয়া এলাকা থেকে সমীক্ষা কাজের পন্টুন ও যন্ত্রাশং সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই সব সমীক্ষা কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
মেঘনা নদী পার হওয়ার জন্য চাঁদপুর-শরীয়তপুরে এখন ফেরিই একমাত্র উপায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ফেরিগুলো বিকল হলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় গণপরিবহন ও মালবাহী যানবাহনগুলোকে। অনেক সময় পার হওয়ার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হয়। তবে এখানে সেতু হলে সিলেটসহ দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের ২৫ জেলার সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগের সড়ক পথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে এবং দেশের অর্থনীতিতেও পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে তিনটি নৌ বন্দরের মধ্যে।
পদ্মা সেতুর পরে সরকার মেঘনা নদীতে সেতু নির্মাণ করতে চায়। সে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) চাঁদপুর-শরীয়তপুর নৌপথে সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে। ওই পথের মেঘনা নদী ও নদীর তীর মিলিয়ে ১৫ কিলোমিটার এলাকার ১২টি স্থানে মাটি পরীক্ষার কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এ ছাড়া চলছে নদীর মরফলজি ও হাইড্রোলজি পরীক্ষার কাজ। আগামী ডিসেম্বরে এসব সমীক্ষার প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ করা হবে। আর এর সম্ভাব্য ব্যয় কত হবে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ২৫ জেলার পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহন চাঁদপুর-শরীয়তপুর নৌপথের মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করে। এ জন্য শরীয়তপুরের নরসিংহপুর ও চাঁদপুরের হরিনা ফেরিঘাট ব্যবহার করতে হয়।
হরিণা ফেরিঘাটে অপেক্ষায় থাকা যাত্রীবাহী বাস অথৈ পরিবহনের চালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মেঘনা সেতু হলে অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো হবে। যানজট হবে না এবং সময়ও কম লাগবে। এখন তো আমাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন।
চট্টগ্রাম থেকে আসা বাগেরহাটের যাত্রীদের মধ্যে সোলাইমান ও রাকিব বলেন, আমরাও চাই, এখানে সেতু হোক। এটি নির্মাণ হলে সাধারণ মানুষ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত হবে। দীর্ঘ সময় আমাদের যানজটে অপেক্ষা করতে হবে না।
নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় গত বছর জুন মাসে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪৩ কোটি টাকা। তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। এগুলো হলো দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান দোহা, স্পেনের তিপশা ও জাপানের নিপ্পন কোয়েক।
গত জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানগুলো মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। প্রথম এক মাস ট্রাফিক সার্ভে করা হয়। ওই পথ দিয়ে কত যানবাহন চলাচল করে, কী ধরনের যানবাহন চলাচল করে। তাতে অর্থনৈতিক প্রভাব কী রকম আছে।
এরপর মেঘনা নদীতে মরফলজি ও হাইড্রোলজি পরীক্ষার কাজ শুরু করা হয়। গত মার্চ থেকে মাটি পরীক্ষার কাজ শুরু করা হয়েছে। মেঘনা নদী ও নদীর তীর মিলিয়ে ১৫ কিলোমিটার এলাকায় মাটি পরীক্ষার জন্য বোরিং করা হচ্ছে। এর মধ্যে নদীতে আটটি ও স্থলে চারটি স্থানে বোরিং করা হবে। ১২০ থেকে ১৫০ মিটার গভীর থেকে মাটি পরীক্ষা করা হচ্ছে।
মেঘনায় সয়েল টেস্ট বোরিংয়ের কাজ করছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (ডিসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প সহকারী প্রকৌশলী তানভির আহম্মেদ বলেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে সয়েল টেস্টের বোরিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। চারটি স্থানের মাটি তুলে তা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। একটি শরীয়তপুরের নরসিংহপুরে আর তিনটি চাঁদপুরের হরিনায়। আগস্টের মধ্যে সয়েল টেস্টের মাঠপর্যায়ের কাজ শেষ হবে।
শরীয়তপুর-চাঁদপুর ‘মেঘনা সেতু সমীক্ষা প্রকল্প’ পরিচালক লিয়াকত আলী মোবাইল ফোনে জানান, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হবে। কয়েক ধাপে এ সমীক্ষা হয়। এরই মধ্যে নদীর মাটি ও ভূগর্ভস্থ অবস্থা নির্ণয় হয়েছে। এরপর অর্থয়ানের বিষয় রয়েছে। আমি রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর সরকার সেতু নির্মাণে অগ্রসর হবে।
সম্প্রতি পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম সেতুর সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ পরিদর্শনে এসে বলেন, শরীয়তপুর এবং চাঁদপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি মেঘনা সেতু নির্মাণ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ৩০ জুনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তিনি আশা করেন, এ বছরের মধ্যেই ফিজিবিলিটি সমীক্ষা সম্পন্ন করবেন তারা।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে নৌপথটি উদ্বোধন করা হয়। এই পথ দিয়ে বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্যবাহী যানবাহন চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় চলাচল করে। পথটি ব্যবহার করার ফলে যানবাহনগুলোকে ঢাকার যানজটে পড়তে হচ্ছে না। আর দূরত্ব কমেছে ৬০–৭০ কিলোমিটার।মেঘণা সেতু নির্মাণের সাথে সাথে চাঁদপুর - শরীয়তপুর - লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক ফোরলেইন অন্তভুর্ক্ত হতে পারে। সেতুর পাশাপাশি জোরালো হচ্ছে ফোরলেইন সড়কও।