ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পাহাড়ে বসবাসকারীদের স্থায়ী পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : শনিবার ১৮ জুন ২০২২ ০১:০০:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন

প্রতিবছরের মতো এবছরও বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের শঙ্কা ছিল। যা আঁচ করতে পেরেছিল প্রশাসনও। তাই তাদেরকে সেখান থেকে সরে যেতে তাগাদাও দেওয়া হয়। কিন্তু কোনভাবেই পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানো যায়নি।  

এমনকি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো উচ্ছেদ করতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় জেলা প্রশাসন। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়েই বসবাস করছে শত শত পরিবার। যার কারণে ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা। পাহাড়ে বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেই।

শনিবার (১৮ জুন) নগরের বাটালি হিল, মতিঝর্ণা, আকবরশাহ, হিল-১, হিল-২ এবং বায়েজিদ লিংক রোড সংলগ্ন পাহাড়, ফয়েজ লেক সংলগ্ন ১ নম্বর  ঝিল, ২ নম্বর ঝিল, ৩ নম্বর ঝিল, আমিন জুট মিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ঝুঁকি নিয়ে শত শত পরিবার তাদের বসতঘর তৈরি করেছেন। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে সেখান থেকে বেশকিছু পরিবারকে নিরাপদ দূরত্বে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হলেও কিছু পরিবার থেকে যায়।  

এর আগে শুক্রবার (১৭ জুন) সকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করা হয়। প্রস্তুত রাখা হয় জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আগ্রাবাদ, বাকলিয়া, কাট্টলি ও চান্দগাঁও সার্কেলাধীন ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র।  এছাড়াও সীতাকুণ্ড উপজেলা,  রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, চন্দনাইশ, হাটহাজারী, লোহাগাড়াতেও পাহাড় ধস এবং ফ্ল্যাশ ফ্লাডের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত আছে।

জেলা প্রশাসনের নির্দেশনার পরও অনেক পরিবার রাতেই ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে থেকে যায়। যার কারণে শুক্রবার (১৭ জুন) দিবাগত রাত ১টার দিকে আকবর শাহ থানাধীন বরিশাল ঘোনা ও রাত ৩টার দিকে ফয়’স লেকের বিজয় নগর এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ৪ জন নিহত হন। এছাড়াও আহত হয়েছেন ১১ জন।

 

দীর্ঘদিনের এ সমস্যা সমাধানে স্থায়ী কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, চট্টগ্রামে প্রতিবছর কোনো না কোনো জায়গায় পাহাড় ধসে ঘটছে প্রাণহানি। গত ১৩ বছরে পাহাড় ধসে দুই শতাধিক মানুষের মুত্যু হলেও থেমে নেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। টানা ভারি বৃষ্টিতেও পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অনেক পরিবার। তাদের সরানো হয় শুধু বর্ষা মৌসুমে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড় ধসের শঙ্কা বাড়ে। এর পর কিছু উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। ভারি বৃষ্টি হলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে রাখেন তারা। বর্ষা চলে গেলে আর কোনও খবর থাকে না। যার কারণে প্রতিবছর পাহাড় ধসে প্রাণহানি হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে সম্পদ। এতগুলো প্রাণহানির দায়িত্ব কে নিবে? 

তিনি আরও বলেন, যদি স্থায়ী কোনও সমাধান না হয় তাহলে প্রাণহানি আরও বাড়বে। নগরীতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করছে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। তাদেরকে সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী। আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরিকল্পিত নগরীতে কোন পরিকল্পনা নেই। যদি পরিকল্পনা থাকতো তাহলে তাদের কোথাও স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়া যেত।

নগরে ৬৫ পাহাড়ের মধ্যে ৩৪ পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এর মধ্যে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি।

বসবাসকারীরা বলছেন, শুধু ভারি বৃষ্টি হলেই আমাদের নিয়ে যায়। পরে আর খবর থাকে না। তাদের অভিযোগ, পাহাড়ের পাদদেশে ঘর নির্মাণের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারাই পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করে নিম্ন আয়ের লোকজনকে কম ভাড়ার কথা বলে বসবাসের প্ররোচনা দেন। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। শুধু বর্ষা এলেই বসতি উচ্ছেদ করে।

প্রায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণহানির পাশাপাশি অনেককে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। নষ্ট হয় সম্পদ। পাহাড় ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। সে বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যায় ৩০ জন। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বৃষ্টির সময় নগরের বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে তিনজন নিহত হয়। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ে মারা যায়। সর্বশেষ শনিবার দিবাগত রাতে ৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১১ জন।  

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বছরব্যাপী কর্মসূচি থাকে। পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের সরাতে আমরা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। এরপরেও তারা সেখানে থাকছে। এবার আমরা কঠোর হবো।