দেশি কাজু বাদামের ফলন ও বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় এর চাষ নিয়ে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন বান্দরবানের চাষিরা। এ জেলার প্রায় সব উপজেলায় চাষ হলেও রুমা ও থানচিতে তুলনামূলক বেশি চাষ হয় এই দেশীয় কাজু বাদামের।
জানা যায়, একসময় শুধু জুম চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন পাহাড়িরা। দিন দিন জুমের জায়গা সংকুচিত হওয়ার কারণে এখন পাহাড়িরা স্থায়ী ফলদ বাগান করার দিকেই ঝুঁকছেন। পাহাড়ে কলা, আম, কুল, কাজু বাদাম ভালো উৎপাদন হয়। এছাড়া অধিকাংশ চাষিরাই কাজু বাদাম সংগ্রহ করে বাজারজাত করা শুরু করেছেন, দামও ভালো পাচ্ছেন।
রুমা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কাজু চাষ হলেও থানছি উপজেলায় রাস্তার ধারে দেখা মেলে ছোট-বড় কাজু বাদাম বাগানের। জৈষ্ঠ্যমাসে অন্যান্য ফলের পাশাপাশি এই ফলও পরিপক্ক হয়ে পাকতে শুরু করে। এতে থোকায় থোকায় ঝুলতে দেখা যায় লাল, হলুদ রঙের পাকা কাজু বাদাম। স্থানীয় ভাষায় এটি টাম নামে পরিচিত। কেউ আবার কেসনাটও বলেন।
বলিপাড়া ইউনিয়নের বিদ্যামনি পাড়ার কাজু বাদাম চাষি ফোসা উ মারমা বলেন, কৌতূহল থেকে ১০ থেকে ১২ বছর আগে পাঁচ একর জায়গায় দেশীয় কাজু বাদাম গাছ লাগিয়েছিলাম এবং ৪ বছরের মধ্যেই ফলন এসেছিল। একসময় বাগানেই পঁচে যেত, বিক্রি হতো না। খাওয়ার মতো লোকজনও নেই। এমনিতেই পড়ে থাকতো। এখন প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাগানে এসে কাজু বাদামের খোঁজ-খবর নেন। অনেকে আবার বাড়ির আঙিনা থেকেই কিনে নিয়ে যান।’
ফোসা জানান, গতবছর ৫০ মণ কাজু বাদাম প্রতি মণ ৩ হাজার টাকা করে বিক্রি করেছিলেন। ৪ বছর আগে কাজু বাদাম প্রতি মণ সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। এ বছর ৮০ মণ পেয়েছেন। প্রতিমণ ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে বাজারে বিক্রি করেছেন।
থানছি সদর ইউনিয়নের থানদাক পাড়ার কাজু বাদাম চাষি উবামং মারমা বলেন, এ বছর ৪৫ মণ কাজু বাদাম হবে বলে আশাবাদী। তিনি জানান, এরই মধ্যে প্রতিমণ তিন হাজার পাঁচশত টাকা করে ২০ মণ কাজু বাদাম বিক্রি করেছেন। গত বছর ৩৫ মণ পেয়েছিলেন, কিন্তু করোনার কারণে দাম কম ছিল। তখন প্রতিমণ তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন।
বলি পাড়া ইউনিয়নের বাগান পাড়ার বাসিন্দা কর্ণজয় ত্রিপুরা জানান, তার মাত্র ২০০ কাজু বাদাম গাছ আছে। এবছর ফলন ভালো হয়েছে। ১০-১২ মণ ফল পেতে পারেন বলে আশা করছেন তিনি। তাদের পাড়ায় ১০ পরিবার কাজু বাগান চাষি আছেন।
তিনি বলেন, এলাকায় এখন কাজু বাদাম চাষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। চাষিরা কাজু বাদাম চাষে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছেন। এখন ন্যায্য মূল্য পেলে ভালো হয়। সরকারের পক্ষ থেকে শুষ্ক মৌসুমে বাগানে পানি সেচ ও সারের সহযোগিতা পেলে খুব ভালো হতো বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে চাষিদের কাছ থেকে মণ প্রতি ৩৩০০ থেকে ৩৫০০০ টাকা করে কাজু বাদাম কিনছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ এগ্রিকালচার প্রোডাক্টস লিমিটেডের ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর রেম্বো ত্রিপুরা।
বান্দরবান কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, সাত উপজেলায় ২৮৮২ জন কাজু বাদাম চাষি আছেন। মোট ১৮৩৭ হেক্টর জায়গায় কাজু বাদাম চাষ হচ্ছে। গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১ হাজার ২১২ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছিল। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩২৩ মেট্রিক টন কাজুবাদাম উৎপাদন হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ১.৩১ মেট্রিক টন বাদাম উৎপাদন হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও কাজু বাদামের চারা উৎপাদন ও বিপনন করা হয়। বান্দরবান সদর উপজেলা সুয়ালক ইউনিয়নে এলএ এগ্রো কোম্পানির নার্সারির ব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল জানান, তাদের নার্সারি থেকে বিশ্বের উন্নত জাতের এম-২৩ কাজু বাদামের চারা প্রতি পিস ১৫০ টাকা করে বিক্রি করছেন। গত বছর ১ লাখ চারা বিক্রি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি ।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য জেলা বান্দরবানে দিন দিন কাজু বাদামের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে চাষিদেরকে সার, কৃষি উপকরণ প্রদানসহ সার্বিক পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে কাজু বাদাম গাছে পানি সেচ ব্যবস্থা করার জন্য বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, চারা লাগানোর ৩-৫ বছরে ভালো ফলন দেয় এবং রোগবালাইও কম। এ জেলার মাটি কাজু বাদাম চাষের উপযোগী হওয়ায় ভালো ফলন পাচ্ছেন চাষিরা।