কৃষিতে স্বনির্ভর দেশের উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও। ধান, গম, ভুট্টাসহ প্রায় সব ধরনের ফসল ও সবজির পাশাপাশি আলুর উৎপাদনও বেশ ভালো হয় এ জেলায়। তাই বাড়তি লাভের আশায় এখানে প্রতি বছর আগাম আলু চাষ করা হয়।
জেলার ৫টি উপজেলায় এখনো রোপা আমন ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়নি। তবে সদ্য ফাঁকা হওয়া জমিগুলোতে এখন আগাম আলু চাষ করতে ব্যস্ত রয়েছেন চাষিরা। তবে এবার অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয়ে একরকম ঝুঁকি নিয়েই আলু চাষে নামছেন কৃষকেরা। গত বছর আলুর ভালো দাম পাওয়ায় এবার বেশ আশা নিয়েই ঝুঁকি নিচ্ছেন তারা।
কৃষি অফিসের তথ্যমতে, জেলাজুড়ে ডায়মন্ড, অ্যাস্টেরিক ও কার্টিনাল নামে আগাম জাতের আলু চাষ করা হয়েছে। এ তিন জাতের আলু রোপণের ৫৫-৬০ দিনের মাথায় বিক্রির উপযোগী হয়। জেলায় চলতি মৌসুমে ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আগাম চাষ হয়েছে ২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে। এবার আলুর ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেইসাথে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি মৌসুমে আলুর ভালো ফলনে আশাবাদি কৃষি বিভাগ।
জানা যায়, এ বছর কৃষকেরা বাইরে থেকে আলুর বীজ কিনছেন ৮০-৮৫ টাকায়। যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ২৫-৩০ টাকা। এক মৌসমের আগের হিসেবে এই দাম দ্বিগুণেরও বেশি। এ ছাড়া সারের বস্তা প্রতি দাম বেড়েছে ২০০ টাকা পর্যন্ত। অতিরিক্ত সেচ ও কীটনাশক খরচের ফলে উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে অস্বাভাবিক।
এবার সরকারি যে আলুর বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে; সেই আলুর বীজ জাতভেদে ৫৭ টাকা থেকে শুরু করে ৬৬ টাকা পর্যন্ত কেজি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় বীজ অপ্রতুল। ২০-২৫ শতাংশ আলুর বীজ উৎপাদন করে বিএডিসি। বাকি আলু কৃষক তাদের ঘরে রাখেন ও বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও ও প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে। সরকারি আলুর বীজ পর্যাপ্ত না হওয়ায় কৃষক বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনে থাকেন। গত বছর আলুর বীজ ৫০-৬০ টাকায় কিনতে পেরেছিলেন। যা আগের মৌসুমে ছিল ৩০-৩৫ টাকা। তবে সেই বীজ এবার ৮০-৮৫ টাকা পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে।
একই দৃশ্যের দেখা মেলে সারের ক্ষেত্রেও। ডিলাররা ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) সরকারি মূল্য ১২৫০ টাকায় কেনেন কিন্তু বিক্রি করেন ১৩৫০ টাকায়। ডাই-অ্যামনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সরকারি মূল্য ৯৫০ টাকা হলেও বিক্রি হয় ১০৫০ টাকায়। মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সরকারি মূল্য ৯০০ টাকা হলেও ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইউরিয়া সরকারি মূল্য ১২৫০ টাকা হলেও ১৩৫০ টাকায় চাষি পর্যায়ে বিক্রি করেন
কিন্তু কৃষককে তিউনেশিয়ার ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) ১৭০০ টাকা এবং দেশি ২২০০ টাকা, ডাই-অ্যামনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) মরক্কো ১১০০ টাকা ও দেশি ১৫০০ টাকা, মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) কানাডা ১২০০ টাকা ও রাশিয়া সরকারি মূল্যেই কিনতে হচ্ছে। তাছাড়া কোনো ডিলারই ভাউচার দিচ্ছেন না। ভাউচার চাইলে সার দিচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন একাধিক কৃষক।
কৃষকেরা বলছেন, গত দুই মৌসুমে আলুর দাম ভালো দেখেই এ বছর তারা বাড়তি উৎপাদন ব্যয়ের ঝুঁকি নিয়েই আলুর চাষ করছেন। তবে সরকারি রেটে বীজ, সার ও কীটনাশক পেলে তাদের উৎপাদন ব্যয় অনেকটা কমানো সম্ভব হতো। সঠিক বাজারমূল্য না পেলে পুঁজি হারাতে হবে এসব কৃষকদের।
নারগুন কহরপাড়া এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর আলুর বীজ, সার ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি পেয়ে খরচ দ্বিগুণ হয়েছিল। তবে এ বছর খরচ আরও বেড়েছে। যদি গতবারের মতো দাম না পাই, তাহলে এবার আমাদের সব হারাতে হবে।’
সেনুয়া এলাকার কৃষক ময়নুল বলেন, ‘গত বছরেও ৫০ শতক জমিতে আলুর খরচ হয়েছে ৩০-৪০ হাজার টাকা। এ বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার টাকা। প্রতি বছর আলু চাষ করি। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও করলাম। ভালো বাজার নিয়ে আমি খুবই শঙ্কায় আছি।’
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মাঠ পর্যায়ে গিয়ে আলু চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছি। ঠাকুরগাঁওয়ের মাটি ও প্রকৃতি আলুর জন্য যথেষ্ট উপযোগী। তবে এবার উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় সঠিক বাজারমূল্যের মাধ্যমে কৃষকেরা খরচ তুলতে সক্ষম হলেই তাদের পরিশ্রম সফল হবে।’
বায়ান্ন/প্রতিনিধি/একে