ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের প্রথমটিই হলো বীজ অর্থাৎ, বীজ হচ্ছে ফসলের প্রাণ। তাই চিরন্তন সত্য হচ্ছে ‘ভালো বীজে ভালো ফসল’। এর কোনো বিকল্প নেই।
বীজ যে জাতের সে জাতের নির্দিষ্ট গুণাবলী অবশ্যই থাকতে হবে। আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি। আর যে কোনো ফসল উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে বীজ। কৃষি নির্ভর এ দেশের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ এবং দারিদ্র বিমোচনের জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের বীজ ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, একই ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র মানসম্পন্ন ভালো বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বর্ধিত ফলন পাওয়া সম্ভব।
কৃষক তাদের ফসল উৎপাদনের বীজ বিভিন্ন ভাবে সংগ্রহ করে। সব সময় ভাল বীজ না পেয়ে অনেক কৃষক প্রতারিত হয়ে থাকেন। কৃষকরা যেন প্রতারণার স্বীকার না হয় যে লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রন্তিক পর্যায়ে কৃষদের দ্বারা বীজ উৎপাদন করছে কৃষি বিভাগ। এই বীজকে মান সম্মত করার জন্য স্থানীয় উপ-সহকারি কৃষি অফিসাররা সব সময় কৃষকের পাশে থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগ থেকে বীজ উৎপাদনের জন্য কৃষকদের বিনামূল্যে সার, বীজ, বালাইনাশক, নগদ অর্থ ও বীজ সংরক্ষণের জন্য উপকরণ দেয়া হচ্ছে। কৃষকে ভালো বীজের জন্য দুরে কোথাও যেতে না হয় সে কারণেই এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কৃষি কাজে সময়, খরচ বাচানোর জন্যই এই কার্যক্রম।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বীজ উৎপাদন সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য কৃষি বিভাগের দুটি প্রকল্প কাজ করছে। ধান গম ও পাট বীজ উৎপাদনের জন্য একটি প্রকল্প ও ডাল তেল জতীয় ফসল উৎপাদনের জন্য একটি প্রকল্প কাজ করছে। ধান গম ও পাট বীজ উৎপাদনের জন্য প্রকল্পটি বোরো ধান, রোপা আমন, আউশ, গম ও পাট বীজ উৎপাদনের জন্য কাজ করছে। আর ডাল তেল জতীয় ফসল উৎপাদনের জন্য প্রকল্পটি ডাল জাতীয় ফসল ও তেল জাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদনের জন্য কাজ করছে। জেলায় ধান গম ও পাট বীজ উৎপাদনের জন্য প্রকল্পের আওতায় বোরো ধানের ১১৩ টি, রোপা আমনের ৫৬টি, আউশের ২৩টি, গমের ২৮টি ও পাটের ৪ টিসহ মোট ২৩৪টি কৃষক গ্রুপ কাজ করছে। এছাড়া ডাল জাতীয় ফসল ও তেল জাতীয় ফসলের ১২৪ টি কৃষক গ্রুপ কাজ করছে। এই কৃষক গ্রুপগুলোকে পর্যায়ক্রমে বীজ ডিলার হিসেবে নিবন্ধন দেয়া হবে। ইতি মধ্যে ১২ উপজেলার ১৪৮ টি গ্রুপকে বীজ ডিলার হিসেবে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইল সদরে ২৫টি, বাসাইলে ১৪টি, কালিহাতিতে ১০টি, ঘাটাইলে ১০টি, নাগরপুরে ১১টি, মির্জাপুরে ১২টি, মধুপুরে ১৫টি, ভূঞাপুরে ৯টি, গোপালপুরে ৮টি, সখিপুরে ১০টি, দেলদুয়ারে ১২টি ও ধনবাড়িতে ১২টি কৃষক গ্রুপকে বীজ ডিলার হিসেবে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। বাকি ২১০টি কৃষক গ্রুপকে পর্যায়ক্রমে বীজ ডিলার হিসেবে নিবন্ধন দেয়া হবে।
দেলদুয়ার উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের টেউরিয়া গ্রামের কৃষক সোনা মিয়া জানান, ভালো বীজের জন্য আমরা স্থানীয় বাজারে বা টাঙ্গাইল শহরের যাই। কিন্তু অনেক সময় সঠিক বীজ আমরা পাই না। এতে করে ফসল উৎপাদন কমে যায়। কিন্তু আমাদের এই গ্রামেই এখন আমাদের পরিচিত কিছু লোক বীজ উৎপাদন করছে এবং সরকারী ডিলারের নিবন্ধনও আছে। আমরা এখন তাদের কাছ থেকে বীজ নিয়ে চাষাবাদ করি।
কৃষি বিভাগ থেকে বীজ ডিলার হিসেবে নিবন্ধন পাওয়া দেউলী ইউনিয়নের ঝুনকাই গ্রামের কৃষক গ্রুপের সভাপতি আব্দুল করিম জানান, এখন আমার এলাকার কৃষক আমার কাছ থেকেই বিভিন্ন ফসলের বীজ কিনতে পারবে। আমি এখন পর্যন্ত চার মণ সরিষার বীজ, দুই মণ মাসকালাইয়ের বীজ, তিন মণ ধানের বীজ ও কিছু দেশী পাটের বীজ বিক্রি করেছি। এতে আমি যেমন আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছি, তেমনি আমার এলাকার কৃষকরা কম দামে ভাল বীজ পেয়ে উপকৃত হয়েছে।
জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার বিএম রাশেদুল ইসলাম জানান, বীজের গুনগত মান দেখার দায়িত্ব হল বীজ প্রত্যয়ন অফিসের । আমার যে গ্রুপগুলো বীজ উৎপাদন করবে তাদের মাঠ পরিদর্শন করি এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি বিভিন্ন মাঠ স্কুলের মাধ্যমে। এই গ্রুপগুলো সরাসরি বীজ প্রত্যয়ন অফিসের মাধ্যমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইং এ আবেদন করে। আমারা এই আবেদন ছাচাই বাছাই করে প্রত্যায়ন দিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। এর পরই কৃষক বীজ ডিলার হিসেবে নিবন্ধান পায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে আমার প্রন্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্দ্যেক্তা তৈরির কাজ করছি। এই প্রকল্পেরর মাধ্যমে কৃষক ধান,গম,পাট ,তেল ও ডাল জাতীয় ফসলের বীজ উৎপাদন করে থাকে। উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে আমরা কৃষদেরকে বীজ উৎপাদনের জন্য ভিত্তি বীজ সরবরাহ করেছি। কৃষকদের বীজ উৎপাদনের জন্য, সংরক্ষণের জন্য ও বীজ বিক্রির জন্য সকল কিছু দেওয়া হয়। কৃষকের উৎপাদিত বীজ বাজারের বিক্রিত বীজের তুলনায় অনেক উন্নত। এর প্রধান উদ্দেশ্য হল কৃষক পর্যায়ে বীজের যে ঘাটতি রয়েছে তা পুরণ করা। কৃষক যেন এই বীজ উৎপাদনের ধারাকে ধরে রাখে সে জন্য কৃষি বিভাগ কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে তাদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। যাতে এই প্রকল্প চলে গেলেও কৃষক বীজ উৎপাদন ও বীজ বিক্রি করতে পারে। আমারা এই প্রকল্পের মাধ্যমে শতভাগ কৃষক গ্রুপকে বীজ উৎপাদন ও বিক্রির জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইং থেকে বীজ ডিলার হিসেবে তাদের নিবন্ধানের ব্যবস্থা করে দিব।