ঢাকা, শনিবার ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮শে পৌষ ১৪৩১

মিরপুর সাব- রেজিষ্ট্রার অফিসে ঘুষ নেওয়া যেন তাদের অধিকার

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ১৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:০৪:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। কয়েক জনের ঘুষ নেওয়ার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগীরা বলছিলেন ঘুষ নেওয়া যেন তাদের অধিকার। সরকার তাদের ঘুষ নেওয়ার জন্যই চাকরি দিয়েছে। অফিসের পরিবেশ  এমন হয়েগেছে সেবা নিতে আসা মানুষগুলো মানসিকভাবে ঘুষ দেওয়ার  প্রস্তুতি নিয়েই আসেন। মানুষ ছাড়া অন্যকোন প্রাণী আসলেও কাজ হয় না, তাদের ঘুষ দিয়েই কাজ করতে হয়। ক্ষোভের সঙ্গে এসব কথা বলছিলেন সাব রেজিষ্ট্রার কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা আশরাফুল হায়দার। তাঁর শ্বশুর মঞ্জুরুল ইসলাম তিন মেয়ের নামে দুর্গাপুর এলাকার সাড়ে চার কাঠা জমি লিখে দেবেন। কোনো সমস্যা ছাড়া জমিতেও  সাব—রেজিষ্ট্রারের জন্য আলাদা করে ৯ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছেন অফিস স্টাফ মন্জু।

এই অভিযোগ ছাড়াও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রার অফিসের কয়েকজনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তুলেছেন খোদ দলিল লেখক কয়েকজন। সেবা প্রত্যাশীরা তাদের দাবি টাকা ছাড়া রেজিষ্ট্রি হয় বলে তারা জানান। অপকর্ম গোপন রাখতে বহিরাগত এক ব্যক্তিকে দিয়ে অফিসের গোপন নতিসহ অর্থ লেনদেনের কাজ করান রেজিষ্ট্রার রাসেল মল্লিক। জমি রেজিষ্ট্রি করতে গিয়ে জটিলতা হতে পারে তাই সেবা গ্রহীতারা সবকিছু মেনে নেন নীরবে। নিবন্ধন বাতিলের ভয় রয়েছে দলিল লেখকদের।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জমির ক্রেতা—বিক্রেতা, দলিল লেখক আর দালালের প্রচণ্ড ভিড় ভেতরে। সাব রেজিষ্ট্রি কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা ব্যক্তিরা জানান, দালালেরা নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে সহজেই জমি নিবন্ধনের কাজ করিয়ে দেন। কাগজপত্রে সমস্যা থাকলেও ঠিকমতো যাচাই করা হয় না। আর দালাল ছাড়া গেলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়, ঘুরতে হয় মাসের পর মাস।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সাব—রেজিষ্ট্রি অফিসের সাবেক কেরানি আতাউল ইসলামের ভাই রাজিব অফিসের সব অবৈধ অর্থ লেনদেন দেখাশোনা করেন । দলিল রেজিষ্ট্রির সময় কোন দলিল লেখক কয়টি দলিল রেজিষ্ট্রি করতে এসেছেন তা রেজিষ্ট্রারের পাসে বসে তালিকা করেন সাব রেজিষ্ট্রারের সহকারী। অফিসের কাজ শেষে সাব রেজিষ্ট্রার রাসেল মল্লিক বাসায় যাবার পূর্বে রাজিবকে পাঠান তালিকা করে রাখা প্রতিটি দলিল লেখকদের থেকে উৎকোচ এর টাকা সংগ্রহ করতে। এমনটি অভিযোগ করেন মিরপুর সাব রেজিস্টার অফিসের দলিল লেখকেরা। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে মিরপুর সাব—রেজিস্ট্রার রাসেল মল্লিক সাংবাদিক পরিচয় জানার পর কিছু বলতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত রাজিব বলেন, আমি নিয়োগকৃত না তবে এখানে সাব রেজিষ্ট্রার রাসেল মল্লিক স্যারের নির্দেশে এসছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দলিল লেখক বলেন, আমরা সবাই সব জানি কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারি না, বলতে গেলেই লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়ার ভয় দেখান। দলিল লেখকদের শোকেস করেন সাব রেজিষ্ট্রার রাসেল মল্লিক। লাইসেন্স বাতিল করলে আয় বন্ধ হয়ে মরতে হবে তাই চুপ থাকতে বাধ্য হয়। তারা আরও বলেন এক অফিসারের উপর আরেক অফিসার আছে, তার উপরে আছে আরেকজন।কেউ কারোর ধরাছোঁয়ার বাহিরে নয়। এই ঘুষ বাবদ আদায় করা অর্থ ভাগ করে নেন সাব রেজিষ্ট্রার রাসেল মল্লিক সহ অফিসের কর্মকর্তা,কর্মচারী।

অভিযোগ আছে, কুষ্টিয়া মিরপুর সাব রেজিষ্ট্রার অফিসে দলিল লেখকদের জিম্মি করে দলিল রেজিষ্ট্রির সময় বিভিন্ন সমস্যা দেখায়। সাব রেজিষ্ট্রারের খরচ দিলে ঠিক হয়ে যাবে এমন অজুহাতে বাড়তি টাকা নেন। দলিল লেখকদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ জমির দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে দলিল লেখকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৪ সালে আইন মন্ত্রণালয় থেকে দলিল লেখকদের পারিশ্রমিকের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু দলিল লেখকেরা সে নির্দেশনা উপেক্ষা করে সেবাগ্রহীতাদের থেকে ইচ্ছেমতো টাকা নিচ্ছেন।

দলিল লেখক সভাপতি আমিরুল ইসলাম হাসেম বলেন, দলিল রেজিষ্ট্রি করতে আসা ব্যক্তিদের নামের অক্ষরে সামান্য ভুল থাকলে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র কর্তৃক প্রত্যয়ন পত্র গ্রহণ না করলেও প্রতি নাম ভুলের জন্য ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ ঘুষ দিলে সব ঠিক হয়ে যায়। আমরা এর থেকে মুক্তি চাই।


মিরপুর দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম কুরবান বলেন, দলিল লেখকরা বাধ্য হচ্ছেন রেজিষ্ট্রি করতে আসা মানুষদের কাছে বেশি টাকা নিতে। কারন অফিস শেষ হলেই শেরেস্তাদার রাজিব দলিল প্রতি টাকা নিতে চলে আসেন। এই ভাগ না দিলে হবে না দলিল রেজিষ্ট্রি, সুধু তাই নয় এই ঘুষ দিতে অস্বীকার করলে দলিল লেখকদের নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়ার হুমকির সম্মুখে পড়তে হচ্ছে প্রায়ই আমাদের।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাব রেজষ্ট্রার রাসেল মল্লিক বলেন, আমার উপর আনিত এ সকল অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। নামের ভুলের ক্ষেত্রে কোর্টের এফিডেভিট ব্যতীত আমি দলিল রেজিষ্ট্রি করি না। কুষ্টিয়া জেলা সাব রেজিষ্ট্রার বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করার আশ্বাস দেন।