ঢাকা, শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটি মা: গভীর রাতেও অপেক্ষায় থাকতেন

এমএ রহিম, সিলেট : | প্রকাশের সময় : রবিবার ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ০৩:১৯:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

‘কঠোর শাসন বলতে যা বুঝায় মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে তার সবই পেয়েছি। আদর, সোহাগ, স্নেহেরও কমতি ছিল না। মায়ের নিজস্ব গন্ডি ছিল। ওই গন্ডির বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। গন্ডির বাইরে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় মায়ের শিষ্টাচার, অভিজাত আদর্শে ৫ ভাইবোন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি। যা আজ ৫ ভাইবোনের সংসারে বিরাজ করছে। মায়ের আদর্শ ধারণ করে আমরা ৫ ভাইবোন গর্বিত। মায়ের আদর, শাসন আজো অনুভব করি প্রতিটা মূহূর্তে। মহান সৃষ্টিকর্তার ডাকে মা চলে গেছেন পরপারে। কিন্তু রেখে গেছেন আদর্শ। এখানেই শেষ নয়। বাবাও নির্ভরশীল ছিলেন মায়ের উপর। যার জন্যে মা নানার বাড়িতে গেলে ২-১ দিনের বেশি অবস্থান করতেন না। বাবার প্রতিটি কাজেই মা কাজ করতেন সহযোগি হয়ে। মায়ের সহযোগিতা ছাড়া নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করতে বেগ পেতে হতো বাবাকে। খাওয়া দাওয়াসহ রুটি মাফিক বাবার প্রতিটি কাজের উপর নজর রাখতেন মা। সব মিলিয়ে পুরো পরিবার আগলে রাখতেন মা।’

 

মমতাময়ী মা লতিফা চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেকটা আবেগতাড়িত হয়ে উঠেন সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মিফতাহ সিদ্দিকী। বলেন মায়ের সমকক্ষ কেউ নেই। লতিফা চৌধুরী ২০১২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। বাবা দেলওয়ার হুসেন সিদ্দিকী ইন্তেকাল করেন ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি।

 

৫ ভাইবোনের মধ্যে হাফছা খানম সিদ্দিকী ও জলী সিদ্দিকী স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসারে আছেন। ভাই সোহেল সিদ্দিকী ও তোফায়েল সিদ্দিকী বসবাস করেন যুক্তরাজ্যে। সর্বকনিষ্ঠ মিফতাহ সিদ্দিকী স্থায়ীভাবে বসবাস করেন সিলেট নগরীতে। ছাত্রদলের রাজনীতি দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করা মিফতাহ সিদ্দিকী সর্বশেষ সিলেট মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ছিলেন।

 

মিফতাহ সিদ্দিকী জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার আগিহুন গ্রামে। পুরো পরিবার বসবাস করতেন মৌলভীবাজার শহরে। সেখানেই মিফতাহ সিদ্দিকীর জন্ম। শৈশব, কৈশর এই জেলা শহরেই কেটেছে। এই সময়ে মায়ের কঠোর শাসন আর আদরের কথা তুলে ধরেছেন তিনি।

 

শৈশবের কথা বলতে গিয়ে মিফতাহ সিদ্দিকী বলেন, তিনি ছিলেন সংসারের সর্বকনিষ্ঠ। যখন বুঝতে শেখেন, তখন তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে নিয়ম মাফিক চলাফেরা করতে শুরু করেন। সকালের ফজর নামাজের আজান পড়তেই মা-বাবা উভয়ে জেগে উঠতেন। আমরা ৫ ভাইবোনকেও জাগিয়ে তুলতেন। ফজরের নামাজের জন্যে তাড়া দিতেন। মা-বাবা উভয়ে নামাজ আদায় করে দেখতেন আমাদের অবস্থান। কেউ নামাজ নিয়ে উজর আপত্তি করলে, তার উপর নেমে আসত শাস্তির খড়গ। তাই কেউ নামাজ কাজা করার সাহস করতো না। নামাজ শেষে নিজ নিজ টেবিলে বই নিয়ে বসতে হতো। প্রত্যেকের আবার পৃথক টেবিল ছিল। সকলের টেবিলে সকালের নাস্তা হিসেবে মাল্টোভা ও আপেল চলে যেত। অনেক সময় এসব খেতে ইচ্ছে হতো না। কিন্তু মায়ের কঠিন ধমকের কারণে ওইসব খেতে হতো। সকালের ওই নাস্তা শেষে মক্তবে যেতে হতো আরবি পড়ার জন্যে। বাসার কাছাকাছি ছিল মৌলভীবাজার মুসলিম কোয়ার্টার মসজিদের মক্তব। ৫ ভাইবোন এই মক্তবে আরিব শেখেন। পাশপাশি মমতাময়ী মা শিক্ষা দিতেন আরবি।

 

তিনি জানান, মক্তব থেকে বাসায় ফিরে সকালের আরেক দফা নাস্তা শেষে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি। সংসারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মিফতাহ সিদ্দিকী তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন মৌলভাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় তৃতীয় শ্রেণী থেকে। স্কুলটি বাড়ির কাছে হওয়ায় মায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ভাইবোনের হাত ধরে স্কুলে যেতেন। স্কুলে যাওয়ার সময় বড় বোনের কাছে নানান বাহানা তুলে ধরতেন। ওই বাহানার মূল কারণ ছিল ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বোনের সাথে তাঁর ক্লাসে গিয়ে বসা। ছোট ভাইয়ের আবদারও রেখেছেন বড় বোন। এই ফাঁকিবাজীর বিষয়টি মমতাময়ী মা কোনোদিন জানতে পারেননি। স্কুল শেষে বাসায় ফেরার পর সবাই এক টেবিলে বসতেন খাবার খাওয়ার জন্যে। এটা তাঁদের পরিবারের ঐতিহ্য। মা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে এক টেবিলে বসে খেতে হতো। এই নিয়মের কোনো ধরণের ব্যতিক্রম হতো না কখনো।

 

মিফতাহ সিদ্দিকী জানান, কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতেন। এর পর ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন খেলাধূলার জন্যে সরকারি স্কুল মাঠেই বিভিন্ন ধরণের খেলাধূলায় অংশ নিতেন। কিন্তু মাগরিবের নামাজের আজানের আগে ফিরতে হতো ঘরে। ঘরে ফিরেই মাগরিবের নামাজ পড়তে যেতেন পাশর্^বর্তী মসজিদে। এই নিয়মও লঙ্ঘন করা যেতো না। সান্ধ্যকালীন নাস্তা শেষে পড়ার টেবিলে। সবার টেবিল আলাদা হওয়ায় কেউ কেউ উচ্চস্বরে পড়তেন। কারণ পাশের ঘরে অবস্থানরত মায়ের কাছে জানান দেয়া, তাঁরা পড়ছেন। রাত ১১ টার মধ্যে লেখাপড়া শেষ হয়ে যেত। এর পরপরই সবাই এক টেবিলে গিয়ে বসতেন খাবারের জন্যে। খাবার শেষে সবাই নিজ নিজ ঘরে। মমতাময়ী মা নজরদারি করতেন কেউ ঘুমে ফাঁকি দিচ্ছেন কিনা। ফাঁকি ধরা পড়লে শাস্তি। এর পর মা ঘরের যাবতীয় কাজ শেষ করতেন। গভীর রাতে যেতেন ঘুমাতে। এই ঘুমাতে যাওয়ার আগে খবর নিতেন সন্তানরা ঘুমাচ্ছেন কি না। এই হচ্ছেন প্রিয় মা লতিফা চৌধুরী।

 

মিফতাহ সিদ্দিকী জানান, মায়ের কঠোর নজরদারির মধ্য দিয়ে তিনি মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি, এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এর আগে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি ও ৮ম শ্রেণিতে সরকারি বৃত্তি পেয়েছিলেন। মমতাময়ী মা শিক্ষাদানে পরিকল্পিত ভূমিকা পালন করেছেন। স্কুলের প্রশ্নপত্রের আদলে প্রশ্ন তৈরি করে বাসায় পরীক্ষা নিতেন। উত্তর অনুযায়ী নম্বর দিতেন। এভাবে শিক্ষায় পরিবারের সকল সদস্যকে পারদর্শী করে তুলেন।  

 

তিনি জানান, স্কুল জবানায় মায়ের উৎসাহের কারণে যুব রেডক্রিসেন্টে যোগ দেন। এই সংস্থার হয়ে অংশ নেন ক্যাম্পেইনে। জাতীয়ভাবে এই সংস্থার ক্যাম্পেইনে অংশ নিতে  স্কুল জবানায় ঢাকায় যেতে হয়েছিলেন। যুব রেডক্রিসেন্টের ক্যাম্পেইনে যোগ দেয়ার পুরো বিষয়টি নির্ভর করেছে মায়ের উপর। মায়ের স্বপ্ন পূরণে ইসলামাকি ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ধারাবাকিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে। সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে জাতীয় পুরুষ্কার লাভ করেন। মুখ উজ্জ্বল করেন মায়ের।  

 

ছাত্রদলের রাজনীতি করার কারণে এরাশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন মিফতাহ সিদ্দিকী। আন্দোলন করতে গিয়ে টানা ১০ মাস কারাভোগ করতে হয়েছে। রাজনীতি সম্পর্কে মিফতাহ সিদ্দিকী বলেন, তাঁদের পুরো পরিবারই জিয়ার আদর্শের সৈনিক। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাগো দলে যারা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, মিফতাহ সিদ্দিকীর পিতা দিলওয়ার হুসেন  সিদ্দিকীও জাগো দলের নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। মৌলভীবাজারে জাগো দল থেকে যারা বিএনপির রাজনীতি করেছেন, তাঁরা সবাই বন্ধু ছিলেন বাবার। একই রাজনীতির অনুসারীও। স্বাভাবিকভাবে পুরো পরিবার জিয়ার আদর্শের সৈনিক হয়ে উঠেন। এছাড়া সন্ধ্যার পর তাঁদের বাসার বৈঠকখানায় বাবার সাথে আড্ডা দিতে শহরের বিশিষ্টজনরা মিলিত হতেন। প্রতিদিনই চলত ওই আড্ডা।

 

মিফতাহ সিদ্দিকী জানান, অগ্রহায়ণ মাস এলে তাঁদের পরিবারে উৎসবের আমেজ নেমে আসত। পরিবারের সকল সদস্য গ্রামের বাড়িতে যেতেন। ধান কাটা শুরু হতো। ধান কাটার জন্যে বিশাল আয়োজন। বিশাল কর্মযজ্ঞ। ধান কাটার জন্যে অনেক কর্মচারি রাখা হতো। গরুর সাহায্যে ধান মাড়াই দেয়া হতো। নতুন ধান কাটার কারণে নানান ধরণের পিঠা পায়েস তৈরি হতো। ধান কাট শেষ না হওয়া পর্যন্ত উৎসব চলতোই। মা একাই সামাল দিতেন ওই কর্মযজ্ঞ, উৎসব। ধান কাটা শেষে ফেরার পালা শহরে। প্রতি বছরই রমজান মাস শুরুর কয়েকদিন আগে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যেতে হতো। পুরো মাস ধর্মীয় ভাবগম্ভির্যের মধ্য দিয়ে সিয়াম সাধনা করতে হতো। ঈদ উৎসব শেষে ফিরতে হতো শহরে।

 

মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন মিফতাহ সিদ্দিকী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতির জবানায় পুলিশের হাতে আটক হয়ে কারাগারে যান। কারাগারে যাওয়ার পর মায়ের অস্থিরতা বেড়ে যায়। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন অনেকদিন। কারাগারে বন্দি থাকার সময় পুরো ১০ মাসই মা চোখের জল ফেলেছেন। চোখের জল ফেলা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। সিলেট শহরের বাসায় মা থাকতেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চোখে চোখে রাখতেন। যখনই চোখের আড়াল হয়েছি, তখনই মা অস্থির হয়ে উঠতেন। অনেক সময় গভীর রাতে বাসায় ফেরতাম। দেখতাম মা অপেক্ষা করছেন। দেখা মাত্র মুখ উজ্জল হয়ে উঠতো মায়ের। রাত যত গভীরই হোক না কেন অপেক্ষায় থাকতেন মা। মামলা আর হুলিয়ার কারণে আত্মগোপনে গেলে মায়ের দুই চোখে অবিরাম পানি পড়ত। এভাবে মাকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছেন। তবে মায়ের আদর্শের ভিত্তির উপর নির্ভর করে সর্বত্র বিজয়ী হয়েছি।’