ঢাকা, রবিবার ১৯ মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
আমরা বড় হতভাগা ! পেটে ধরেছিলাম সন্তান, তারপরও হয়নি বাড়ীতে ঠাঁই।

সৃষ্টিকর্তা আমাদের পাশে থাকার জন্য এই মানুষটিকে পাঠিয়েছেন

বসির আহাম্মেদ, ঝিনাইদহ : | প্রকাশের সময় : রবিবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:১৫:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

আমরা বড় হতভাগা ! আমাদের কপাল মন্দ পেটে ধরেছিলাম সন্তান, তারপরও হয়নি বাড়ীতে একটু ঠাঁই। তাই আজ আমাদের ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। বিধাতা যেন সকল মায়ের পেটেই এমন একজন সু-সন্তানের জন্ম দেয়। এক যুগ পার করলাম বুদ্ধাশ্রমে। এমন একজন মানবিক মানুষ এর আগে কখনও পায়নি। সৃষ্টিকর্তা যেন আমাদের পাশে থাকার জন্য এই মানুষটিকে পাঠিয়েছেন। তাকে পাশে পেয়ে আমাদের মনের দীর্ঘদিনের সকল কষ্ট মূহুর্তের মধ্যেই ভুলে গেছি। ফিরে পেয়েছি নতুন এক জীবন। আজ আমরা ধন্য। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি আগামী দিনের পথচলা। সে আর অন্য কেউ নয়। আমাদের সকল মায়ের একমাত্র সন্তান পার্শবর্তী শৈলকুপা উপজেলার কাচেঁরকোল গ্রামের উচ্চ শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের দেশবরেণ্য সৈনিক মেজর অবসর প্রাপ্ত মোঃ মাহফুজুর রহমান। তিনি ঢাকা থেকে এই মায়েদের খোঁজে গিয়েছিলেন হরিনাকুন্ডু উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে তিনি মায়েদের সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন এবং মায়েদের সাথে খেয়েছিলেন দুপুরের খাবার। মায়েদের বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেছিলেন এবার আমি মায়েদের খনি পেয়েছি। যেখানে হীরা, মুক্তা, মানিক সবই আছে। এখানে এসে আমার জীবনের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। যতদিন বেঁচে আছি আমি এসকল মায়েদের পাশে থেকেই সেবা করে যেতে চায়। মায়েরা খুশী হয়ে যাবার সময় তাকে মনখুলে করেছিলেন দোয়া। দিয়েছিলেন তাদের হাতের তৈরী উপহার। আবার কবে ফিরবে মোদের ছেলে সেই অপেক্ষায় পথপানে চেয়ে থাকবে সকল মায়েরা।

আছিয়া বেগম শারিরীক ভাবে অচল হওয়ায় ঠিক মত খাবার দিত না ছেলের বৌ। একবার আম আর দুধভাত খেতে চেয়েছিলেন তিনি। দুধ থাকা স্বত্তেও খেতে দেয়নি তাকে। সে কথা বলতেই গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন যশোরের আছিয়া বেগম। মনে কস্ট থাকলেও সন্তানরা যেন সুখে থাকে সেই দোয়া করেন তিনি।

ঠিক মত খেতে না পাওয়া আর বৃদ্ধা মায়ের জন্য সন্তানদের মাঝে মনমালিন্য’র কারণে আছিয়া বেগমের মত আরও অসহায় ১৯ বৃদ্ধা মায়ের স্থান হয়েছে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া গ্রামের ছোট্ট এই বৃদ্ধাশ্রমে। এখানেই সুখে বসবাস করছেন বৃদ্ধা ২০ জন মা। ঠিক মত খাবার, শাড়ী-কাপড়, ঔষধসহ সবই পাচ্ছেন তারা। অনেকেই একে অপরকে বান্ধবী বলেও ডাকেন। গল্প, আড্ডায় সময় কাটে তাদের। পরিবারে স্থান না হলেও এখানে ভালো আছেন তারা। অবসর সময়ে কেউ করেন নকশী কাথা সেলাই, আবার কেউ কেউ করেন পাটি তৈরীসহ নানা হাতের কাজ। সেগুলো বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে তাদেরই চালানো হয় খরচ। তিন বেলা নিয়মিত খাবার ব্যবস্থা হলেও শত কষ্টেও সন্তানের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই এই বৃদ্ধা মায়েদের।

ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ইসমত আরা জানান, ভাতের কষ্টে বিষ খেয়েছিলেন এক মা। আর সেই কষ্টের ভাগীদার হতেই স্বামীর সহযোগীতায় ২০০৬ তাকে আশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়েই বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠা করেন ইসমত আরা। শুরুতে ৩ শতক জমির উপর টিনের চালা ও চাটাইয়ের ঘর থাকলেও পরে আরো দুই শতক জমি বাড়ানো হয়। বাংলাদেশ সরকার ও জাইকা’র অর্থায়নে ২০১৮ সালে নির্মান করা হয় ৪ কক্ষ বিশিষ্ট পাকা ঘর। হরিণাকুন্ডু উপজেলা শহরে প্রশাসনের দেওয়া দুটি দোকানে বিক্রি করা মায়েদের তৈরী জিসিনপত্র আর খাবার বিক্রির আয় আর উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ভাবে দেওয়া সহযোগিতায় চলে এই বৃদ্ধাশ্রমটি। বাড়িটির ২য় তলার কাজ সম্পুর্ন্ন করতে পারলে আরও ২০ জন মা’কে রাখা যেত এই বৃদ্ধাশ্রমে।

২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সর্বমোট ২৫ জন মা এখানে বসবাস করেন। ৫ জন মারা যাওয়ায় বর্তমানে ২০ জন বসবাস করছেন। তাদের বাড়ী ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকায়।