ঢাকা, শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ই আশ্বিন ১৪৩১

২৬০ টাকা পুজি নিয়ে মাসে আয় প্রায় লাখ টাকা

হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল | প্রকাশের সময় : শনিবার ১১ মার্চ ২০২৩ ১০:৪৭:০০ পূর্বাহ্ন | দেশের খবর

২৬০ টাকা পুজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এখন প্রতি মাসে প্রায় লাখ টাকা আয় করছেন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। সংসার সামলেও ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন ওই নারী উদ্যোক্তা। তার নাম মাহবুবা খান জ্যোতি। এক সন্তানের মা। বর্তমানে তিনি টাঙ্গাইল পৌর শহরের পূর্ব আদালত পাড়া এলাকার একজন পরিচিত মুখ। জ্যোতির কাছে মিলবে পছন্দ অনুযায়ী ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর কেক, বিভিন্ন রকমের আচার, আমসত্ত্ব, হাতের তৈরি ডিজাইনের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও বাচ্চাদের ফতুয়া। খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
জ্যোতির প্রতিষ্ঠানের নাম ‘স্বপ্নের সন্ধানে’। আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের পর সেভাবে এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন না, এমন ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আজ তিনি একজন সফল নারী। প্রায় দেড় মাসে হয়ে গেছেন লাখপতি। ঘরে বসেই তিনি মাসে আয় করছেন প্রায় লাখ টাকা।
পড়াশোনা চলাকালীন বিয়ে হয়ে যায় মাহবুবা খান জ্যোতির। তার স্বামী বর্তমানে মেরিনার ইন্টারন্যাশনাল শিপ এ কর্মরত আছেন। এরপর এক বাচ্চা ও সংসার সামলে কোনো চাকরিতে যোগদান করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করবেন। সময়-সুযোগের অভাবে কিছু করা হয়ে ওঠে নাই। এক মেয়ে একটু বড় হওয়ার পর ভাবলেন কিছু একটা করা উচিত। সে অনুযায়ী ২০২০ সালের প্রথম দিকে জয়েন্ট করেন ‘উই’ নামক একটি ফেসবুক গ্রুপে। জ্যোতি ভরসা করেন উইতে। গ্রুপটিতে যুক্ত হওয়ার পর জানতে পারেন ক্ষুদ্র ব্যবসার ইতিবৃত্ত। ২০২০ সালের জুন মাস থেকে কাজ শুরু করেন। নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করতে শুরু করেন আচার, আমসত্ত্ব। ইতোমধ্যে তার আমসত্ত্ব সাড়া ফেলেছে টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলা ও দেশের বাইরেও।
আমসত্ত্ব, আচারের গুণগত মান নিয়ে সন্তুষ্ট তার ভোক্তারা। তাই অর্জন করেছেন টাঙ্গাইলে আমসত্ত্ব জ্যোতি খেতাব। ক্রেতাদের কাছ থেকেই পেয়েছেন এ নাম। তবে টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলা ও বিদেশে ডেলিভারি দিয়ে থাকেন তিনি। এটাকে আরও প্রসারিত করার চিন্তা তার।
মাহবুবা খান জ্যোতি বলেন, আমি ছিলাম সংসারী বউ আর এক কন্যার মা। অবসর সময়ে ফোনে সময় কাটাতাম বেশি। ২০২০ সালের জুন মাসে জয়েন্ট হয়ে যাই উইতে। সেখানে লাখপতি লাখপতি লাখপতি এসব কথার ছড়াছড়ি। আর একটি নাম ‘রাজীব  স্যার’।  কোনো কৌতুহল  নয়  শুধু ‘রাজীব  স্যার’ কে জানার জন্যই ঘাটাঘাটি  করছিলাম গ্রুপটিতে। প্রত্যেকটা লেখায় পেয়েছিলাম অনুপ্রেরণা।
জ্যোতি বলেন, উদ্যোক্তা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। পেশাগত দিক থেকে আমার স্বামী ‘মেরিনার’ ছুটিতে এসেছিলেন দেশে। মহামারি করোনার জন্য আটকে যান। অভাবের মুখটা তখন দেখতে পাই। ইচ্ছা না থাকলেও স্বামীর পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। দুঃখের ভাগিদার হতে চেয়েছিলাম। লাখপতি হওয়ার জন্য কাজ করিনি। নিজের কাজের ১০০ ভাগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।  লাখপতি হওয়ার আগে ‘মিলিয়নিয়ার’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নটা ছিল বিশাল। অনেকে কটুকথা বলেছেন, আচার সেল, কে খায় আচার? মানুষ কিনে খায় এসব? প্রশ্নের উত্তর দেইনি তখন। জবাবটা হয়তো আজ আমায় দেখে তারা বুঝতে পারেন। মাত্র ৪৩ দিনে পুরোটাই আচার ও আমসত্ত্ব সেল করে লাখপতি হয়ে গেছি। আমি টাকা ইনভেস্ট করে বিজনেস করা পছন্দ করতাম না। টাকা দিয়ে টাকা আনায় বিশ্বাসী ছিলাম। বাসায় স্বামীকে খাওয়ার জন্য আচার করেছিলাম। আর সেই ছবি ফেসবুকে দেই। আর সেখান থেকেই অর্ডার পাই বেশ কয়েক ধরনের আচারের।  
জ্যোতি আরও বলেন, প্রথম অর্ডার ছিল ২৬০ টাকার প্রথম ডেলিভারি, যেটা আমার স্বামী ডেলিভারি দিয়েছিল। টাকাটা আমার হাতে দেওয়ার আগে সালাম করে বলেছিল, ‘তোমার অনেক কষ্টের টাকা’। টাকাটা আমি হাতে নিয়ে বলেছিলাম, ২৬০ টাকা থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার যেদিন করতে পারবো, সেদিন মনটা শান্তি পাবো। টার্গেট পূরণ করতে দুই মাস লেগেছিল। শুরু থেকে আমার স্বামী ও মা অনেক সাপোর্ট করেছে আমায়। পরিবারের সবাই বিপক্ষে থাকলেও মা ও আমার স্বামী পাশে ছিলেন। আমার স্বামী ছিল আমার ভরসার জায়গা। যার উৎসাহ আর সহযোগিতায় আজ আমি এই পর্যায়ে।
উদ্যোক্তা হওয়াটা কতটা সহজ মনে হয় আপনার কাছে, বা একজন নারীর উদ্যোক্তা হতে কী কী যোগ্যতার প্রয়োজন হয় বলে আপনি মনে করেন। তিনি বলেন, মোটেও সহজ নয়। একজন উদ্যোক্তা হতে গেলে মনের সাহসটা থাকতে হয় সব থেকে বেশি। শরীরের জোরের চেয়ে এই কাজে মনের জোরটা বেশি প্রয়োজন। অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন। সামান্য একজন নারী হয়ে উঠতে পারে অসামান্য, যদি সে কাজটাকে ভালোবেসে এগিয়ে যেতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, এটা চ্যালেঞ্জের একটা বিষয়। অনলাইনে ১০ জন কী কাজ করছে, সেটায় ফোকাস না করে ১০ জন কী কাজ করতে লজ্জা পায়, সেটাই আগে খুঁজে বের করা উচিত।  সেটাই আমি করেছিলাম। খাবার নিয়ে কাজ করতে সবাই লজ্জা পায়, সেই সুযোগটাই আমি নিয়েছি। লজ্জা নয়, মনের খুশিতে আমি কাজ করে গেছি। প্রায় ১০-১২ টা দেশে আমার বানানো আচার, আমসত্ত্ব ডেলিভারি দিতে পেরেছি এবং বাংলাদেশের  প্রতিটা জেলায় আমার এই আচার আইটেম পৌঁছে দিয়েছি।
‘স্বপ্নের সন্ধানে’ নামটা ব্র্যান্ড হবে। একটা সময় আমি শতজনকে যেন কর্মসংস্থানের জায়গা করে দিতে পারি। আমার স্বামী বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছিল যে আমি খাবার নিয়ে কাজ করবো। আমার স্বামী বলেছিল তুমি যদি একটা কয়লা নিয়েও কাজ কর সেটাও সেল হবে। সে অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি কেউ। হয়তো আমার কাজটা লজ্জার মনে হতো। যদিও আমি বর্তমানে তা ভুল প্রমাণিত করতে পেরেছি। এখন পরিবারের সবাই আমাকে সাপোর্ট করে। কাজে সবাই সহযোগিতা করে। জ্যোতি আরও বলেন, আমি এখন মাঠ পর্যায়ে গিয়ে প্রথমে ১০ টা ঘর নির্দিষ্ট করবো। সেখানে গিয়ে দেখবো কে কাজ করতেছে, আমাদের বয়সী যারা কাজ করতে আগ্রহী তাদেরকে উৎসাহিত করবো।  
তিনি আরও বলেন, আমার বাবা বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এজিএম ছিলেন (অবসরপ্রাপ্ত), মা গৃহিণী। আমি টাঙ্গাইলের বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান কলেজ থেকে এইচএসসি, কুমুদিনী সরকারি কলেজ থেকে ‘গ্র্যাজুয়েশন’ করে বর্তমানে টাঙ্গাইলের ল কলেজে অধ্যয়নরত আছি। ভবিষ্যতে আরও ধাপ পেরোনোর ইচ্ছা আছে।