ঢাকা, শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০
গাছ যখন জুতার শোরুম

৪১ বছর ধরে জুতা কালি করে চলেছেন সন্তোষ মন্ডল

বেনাপোল প্রতিনিধি : | প্রকাশের সময় : শনিবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৪৮:০০ অপরাহ্ন | এক্সক্লুসিভ

সন্তোষ মন্ডল। বয়স ৬৫  বছর। একজন মুচি। রাস্তার ধারে জুতা সেলাই আর কালি করেন। কালি আর ব্রাশ নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন কখন একজন এসে বলবেন ‘কালি করো’। নিজে নতুন জুতা বানিয়ে বিক্রিও করেন।

২৪ বছর বয়স থেকেই এই পেশায়। এটি তার বাপের পেশা। দাদা ছিল অন্য পেশার।  সন্তোষ বাপের পেশা ধরে রেখেছেন। এই আয় দিয়েই তার সংসার চলে। ৯ জনের সংসার। এখন কাজ কম তাই আগের মত আয় নেই। 

যশোর-বেনাপোল হাইওয়ে সড়কের নাভারণ বাজারের মধ্যস্থল নাভারণ ডিগ্রি কলেজের সামনে একটি শিশু গাছের নিচে একাধারে ৪১  বছর ধরে এই কাজ করছেন সন্তোষ। এই শিশু গাছটিও তার নিজের হাতে লাগানো। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীসহ নাভারণ বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই তাকে চেনেন। তাছাড়া এলাকার অনেকের কাছেই তিনি সন্তোষ দাদা। দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করলেও নিজের ভাগ্য ফেরাতে পারেননি সন্তোষ। বরং সংসারে লোক বাড়াতে তার খরচ বেড়েছে কিন্তু আয় না বাড়ায় বরং অভাব বেড়েছে। সংসারের টানা পোড়েনের পাশাপাশি বেড়েছে ঝঞ্জাট। অভাবের সংসারে বড় বিধবা মেয়ে সীমা (৩৫) দুই সন্তান নিয়ে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত সন্তোষের বাঁচা মরার লড়াইকে আরো কষ্টকর করেছে। অসাধারণ মানুষ সন্তোষ। ৪১ বছর একই স্থানে বসে কাজ করছেন। অথচ আশ পাশের কারো সাথে কখনই ঝগড়া ঝাটি হয়েছে বলে কেউ বলতে পারেননি। অনেক কষ্ট জগদ্দল পাথরের মত তার বুকের উপর চেপে থাকলেও কোন টু-শব্দ নেই।

সন্তোষের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বেনেয়ালী গ্রামে। পিতার নাম সুরেন মন্ডল। তার স্ত্রীর নাম সম্পত্তি। অভাব থাকলেও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক। সন্তোষের ৪ ছেলে মেয়ে। বড় মেয়ে সীমা বয়স ৩৫। বিয়ে হয়েছিল, স্বামী স্ট্রোক করে মারা যাবার পর থেকে দুই ছেলে নিয়ে বাপের সংসারে। দ্বিতীয় সন্তান চন্দন দুই ছেলের জনক। সে বাপের সংসারে একই সাথে থাকে। তৃতীয় সন্তান রতন বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছে। ছোট মেয়ে ইতি দুই মেয়ে নিয়ে স্বামীর সংসারে আছে। বড় ছেলে চন্দন মোটর গ্যারেজে কাজ করে।

অতি গরিব মানুষ সন্তোষ দাদা। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তার। সকালে পান্তা ভাত যা জোটে তাই খেয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে পড়েন। দুপুরে খাওয়া বলতে এক টাকার দুটি বিস্কুট আর এক মগ পানি। বলেন, দুপুরে না খেয়ে খেয়ে আর খিদে লাগে না। সয়ে গেছে।

সন্তোষের ইচ্ছে ছিল একদিন জুতা সেলাই আর কালি করতে করতেই হয়ত একটি নতুন জুতার দোকান দিতে পারবেন। পারবেন  ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে। চেষ্টার কমতি ছিল না  তার। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। তাই ৪১ বছর ধরে একই জায়গায় একই কাজ। সম্পদ বলতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩ শতক জমি। আর নিজের দেহ।

ঘর বলতে সেই টালির দোচালার দুই রুম। দুই মেয়ের বিয়ে হলেও বড় মেয়ে সীমার স্বামী মারা যাওয়ায় দুই ছেলে নিয়ে সে এখন বাপের সংসারে। আত্মীয় স্বজন আসলে ঘরে আর শোবার জায়গা থাকেনা। বারান্দা অথবা পাশের প্রতিবেশীর বারান্দায় ঠাঁই হয় স্বামী স্ত্রীর। এতে সন্তোষের কোন আক্ষেপ নেই। কিন্তু সন্তোষের চিন্তা অন্যখানে। তার কিছু হয়ে গেলে স্ত্রী বেচারার কী হবে।

দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় সন্তোষ দাদা নিজেই সুন্দর সুন্দর জুতা তৈরী করেন। প্রতিদিনের আয় থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় করে তা দিয়ে নতুন জুতা তৈরীর কাঁচামাল চামড়া, রাবার যাকে জুতার সোল বলে এবং আঠাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করেন। পরে তা দিয়ে নতুন জুতা তৈরী করেন। দীর্ঘদিন একই পেশায়, একই জায়গায় তাই অনেকের সাথে তার পরিচিতি এবং সখ্যতা। আর এই পরিচিত গরিব নিম্নবিত্তরাই সন্তোষ দাদার নতুন জুতার খরিদ্দার।

সন্তোষ দাদা আক্ষেপ করে বললেন, আমার জুতার মান অনেক ভালো হলেও ধনী এবং মধ্যবিত্তরা তো ফুটপাতে এসে শিশু গাছে টাঙ্গানো আমার জুতা কিনবে না। পাছে লোকে দেখে ফেললে তাদের জাত যাবে। তাই মাঝে মাঝে যা দু‘এক জোড়া বিক্রি হয় তা ওই গরিব লোকেরাই কেনে।

নতুন জুতা কেন গাছে টাঙিয়ে রেখেছেন ? এ কথা জিজ্ঞাসা করতেই সন্তোষ দাদার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। বললেন, আমার তো কোন দোকান ঘর নেই, যেখানে আমার তৈরী জুতা শো-কেচে শোভা পাবে। তাই খরিদ্দারদের দৃষ্টি আনতেই নতুন জুতা গাছে ঝুলিয়ে রেখেছি। ধরেন, এই শিশু গাছই আমার জুতার শো রুম।

তীব্র গরম আর তাপদাহ, ঝড় বৃস্টি যেমন থেমে থাকে না এই সন্তোষদের জীবন তেমনি ঝড় ঝন্টায় ও পেটের তাগিদে ছাতা মাথায় অন্যের জুতার শোভা বর্ধনে নিজের দেহের সব টুকু শক্তি নিঃশেষ করতেও কার্পন্য করেন না। এক জোড়া জুতা কালি করে ৫, ১০, ১৫ আর কোন সহৃয়বান ব্যক্তি হলে ২০ টাকা দেন। এ টাকায় চলে এদের জীবন। ৬৫ বছরের  সন্তোষদের জীবনের গতি থামানোর উপায় নেই, বিশ্রামেরও সুযোগ নেই, আর বিরতি সে তো অলিক কল্পনা। কেননা, এই পড়ন্ত বিকেলে এসে  বিশ্রাম আর বিরতির কথা ভাবলে তো এদের জীবনই থেমে যাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি নিরন্তর আধা পেটা দেহের উপর ভর করে চলা এই পেশা হতে বেরিয়ে আসার কোন পথ নেই সন্তোষদের। আমাদের উঁচু তলার মানুষদের চাকচিক্য জীবনের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সন্তোষদের রাস্তার পাশে আমরাই খুঁজে ফিরি। স্যালুট সন্তোষ দাদা। আপনার মত নিরহংকার মানুষরাই আমাদের সম্পদ। ন্যুজ্ব দেহ নিয়ে নিরবে সব কিছু মেনে নিয়ে চলেছেন অবিরত। নেই কোন প্রতিবাদ, নেই কোন অভিযোগ, অনুযোগ। বাহ! সন্তোষ দাদা আপনাকে আবারো স্যালুট। কোন সহৃদয়বান তার হাতটা প্রসারিত করতে চাইলে সন্তোষ দাদার এই নম্বরে ০১৭৬৬-৭৪৬০২৩ যোগাযোগ করতে পারেন।