ঝিনাইদহ-৪ আসনের (কালীগঞ্জ) সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পুলিশি তদন্তে আক্তারুজ্জামান শাহীন নামে এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীর নাম উঠে এসেছে। আক্তারুজ্জামান শাহীন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের আসাদুজ্জামান কাঠু মিয়ার ছোট ছেলে ও কোটচাঁদপুর পৌরসভা মেয়র শহীদুজ্জামান সেলিমের ভাই।
ছাত্র জীবন থেকে তিনি অধিক মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন মাদকের সাথে জড়িত। বিত্তবান পরিবারে বেড়ে উঠা ৫৫ বছর বয়সী শাহিন নিজ এলাকায় কলেজ জীবন শেষ করে মেরিন একাডেমীতে ভর্তি হন। পরে জাহাজের ক্যাপ্টেন হয়ে ১৯৯০ সালে পাড়ি জমান আমেরিকায়। পরবর্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। সেই সুযোগে তিনি এলাকায় শুরু করেন মাদক, স্বর্ণ চোরাচালা হুন্ডি সহ নানান অপকর্ম। গড়ে তুলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী ও ক্যাডার বাহিনী। লোক চক্ষুর আড়ালে থেকেই তিনি তার বাহিনী দিয়ে এসব অপকর্ম চালাতেন। এমনকি গত পৌর নির্বাচনে ক্ষমতা ও সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়-ভীতি এবং বিরোধী পক্ষকে হামলা-মামলা দেন। পৌর এলাকায় প্রভাব খাটিয়ে ভাই সহিদুজ্জামান সেলিমকে বানিয়েছেন মেয়র। দেশে বিভিন্ন সময় নানা অপকর্ম করে পাড়ি জমাতেন আমেরিকায়। অভিযোগ রয়েছে কলকাতায় বসে এমপি আনার হত্যার পরিকল্পনা করে আবারো পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
এতদিনে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে না পারলেও বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কোটচাঁদপুর এলাকার নির্যাতনের শিকার মানুষেরা মুখ খুলতে শুরু করেছে। তারা এমপি আনার হত্যার বিচার ও এলাকায় শাহিনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং নির্যাতনের সঠিক বিচার দাবি করেন। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ব্যবসায়ী দ্বন্দ্বের জেরে ভাড়াটিয়া খুনির মাধ্যমে এমপি আনারকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। এরপরেই প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে শাহিনের মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, হত্যা, স্বর্ণ চোরাচালান ও হয়রানিসহ নানা অপকর্মে দীর্ঘদিন ধরে কোটচাঁদপুর এলাকাসহ ঝিনাইদহ জেলাজুড়ে প্রভাব বিস্তারের খবর। কোটচাঁদপুরে গড়ে তুলেছেন আলিসান রিসোর্ট। যেখানে মাদক, নারীসহ চলে নানান অপকর্ম। শাহিনের হাতে নির্যাতনের শিকার স্থানীয়রা এসব অভিযোগ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার বেশ কয়েকজন জানান, ওই বাগান বাড়িতে বিভিন্ন সময় নামীদামি অনেক লোক আসা যাওয়া করেন। রাতে সেখানে মদের আড্ডা আর সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে আমোদ প্রমোদ করা হয়।
এ ব্যাপারে শাহিনের ভাই পৌর মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম জানান, আমার বা আমাদের পরিবারের সঙ্গে তার (আক্তারুজ্জামান শাহীন) কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় কী ব্যবসা করে কিছুই জানি না। ২-৩ বছর পর পর দেশে আসে। মাঝে মধ্যে ভারতে যায়। পরিবারের কারো কাছে কিছুই বলে না।
তিনি বলেন, আমি এখনো পর্যন্ত মেনে নিতে পারছি না বা বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমার ভাই এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছে। এখন যেহেতু তদন্তে তার নাম আসছে, মোবাইলে দেখছি, সেহেতু তদন্ত হোক। সত্যিই যদি আমার ভাই দোষী হয় তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে যা সাজা হয় হবে। আমরা আইনের ঊর্ধ্বে না।
আক্তারুজ্জামান শাহিনের বক্তব্য
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে শাহিন বলেন, আনার হত্যার সময় তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন।
তার দাবি, এই ঘটনায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে। শাহিন বলেন, এই ঘটনার সময় আমি ভারতে ছিলাম না। আমার আইনজীবী বলেছেন এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা না বলতে। মানুষ দেশে অনেক কথাই বলে। যদি কোনো প্রমাণ থাকে তাহলে দেখাক। ফ্ল্যাটের ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমি যদি ফ্ল্যাট ভাড়া নেই। আমি কি আমার ফ্ল্যাটে এই ধরনের কাজ করবো? আমার পাসপোর্ট রেকর্ড দেখলে দেখা যাবে, আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এখন বলা হচ্ছে আমি ৫ কোটি টাকা দিয়েছি।
কীভাবে আমি ৫ কোটি টাকা দিয়েছি, কোথা থেকে পেলাম আমি এত টাকা? এখন এগুলো মানুষ বললে আমার কি করার আছে। ঘটনা কবে ঘটেছে সেগুলো আমি পত্রিকায় দেখেছি। সে সময় আমি বাংলাদেশে ছিলাম।
আক্তারুজ্জামান শাহিন বলেছেন, আমার ড্রাইভার তো কিছু করেনি। আমার গাড়ি, আমার সবকিছু নিয়ে চলে গেছে। এটা কোন ধরনের বিচার। আমি যদি অন্যায় করে থাকি তাহলে আমাকে ধরুক। আমি তো এই দেশে বিচার পাবো না। আমি আমেরিকার নাগরিক, এখানে চলে এসেছি। কি করবো।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য এমপি আনার দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি তার ভারতীয় ঘনিষ্ট বন্ধু পশ্চিমবঙ্গের উত্তর২৪ পরগনা জেলার বরানগর থানার অন্তর্গত ১৭/৩ মণ্ডলপাড়া লেনের বাসিন্দা স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। পরদিন ১৩ মে দুপুরে চিকিৎসক দেখানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। কিন্তু সন্ধ্যায় ফেরার কথা থাকলেও তিনি আর ফিরে আসেননি। এরপর গত ২২ মে কলকতার নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে তার খুন হওয়ার বিষয়টি জানায় ভারতীয় পুলিশ।