সিলেট নগরবাসীর দুর্ভোগের অপর নাম জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি হলেই পানিতে তলিয়ে যায় নগরের রাস্তাঘাট। বাসাবাড়ি আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়ে পানি। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। এর মধ্যে ৫০০ কোটির বেশি টাকা ব্যয়ও করা হয়েছে। এরপরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না নগরবাসী। বরাদ্দ অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরেও নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় অঙ্কের বরাদ্দ রেখেছে সিলেট সিটি করপোরেশন। সোমবার দুপুরে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ১ হাজার ৪০ কোটি ২০ লাখ ৪৩ হাজার টাকার এ বাজেটে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্প খাতে ৪৮০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
গত জুনে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে নগরে। সর্বশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর সকালে মাত্র ৩ ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নগরের বেশির ভাগ এলাকা। এর আগে ১৭ জুলাই মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে একই দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নগরের জলাবদ্ধতা নিসরনে এর আগেও বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প নিয়েছে সিটি করপোরেশন। এখানে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু নগরবাসী তেমন সুফল পাননি। তাই আবার বড় প্রকল্প নেয়ার আগে প্রকল্পগুলোর টাকা কীভাবে ব্যয় হলো তা নগরবাসীকে জানানো উচিত। তিনি বলেন, ‘নতুন করে প্রকল্প গ্রহণের আগে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। না হলে টাকাই শুধু ব্যয় হবে। নগরবাসীর কোনো উপকার হবে না।’
সিসিক সূত্রে জানা গেছে, নগরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবহমান। ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। এতে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে। ছড়া ও ড্রেন দখল এবং ভরাটের কারণেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয় নগরে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা জানায়, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০০৯ সালে ছড়া-খাল খনন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১২ সালে ২৭টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় করা হয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ওই বছরই জলাবদ্ধতা নিরসনে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এরপর ২০১৪ সালে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ২০১৫ সালে আরও ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। সব মিলিয়ে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।
সূত্রটি আরও জানায়, ২০১৯ সালে ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে বরাদ্দ আসে ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় করা হয় ২৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৯৮ কোটি ৪৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। প্রকল্পটির আওতায় অন্যান্য কাজের সঙ্গে ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেন ও ৮ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে।
ছড়া উদ্ধার ও ড্রেন নির্মাণে সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান স্থপতি রাজন দাশ বলেন, ‘এ খাতে বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে কী কাজ হয়েছে তা প্রকাশ করা দরকার। কেন এত প্রকল্পের পরও কোনো লাভ হচ্ছে না, তা জানা দরকার।’
সোমবার বাজেট বক্তৃতায় এ প্রসঙ্গে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, নগরের ছড়া ও ড্রেনের পানি নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু সেই নদীও ড্রেজিং না হওয়াতে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে ঢল নামলে উল্টো সুরমা নদীর পানি নগরের ছড়া দিয়ে ঢুকে এলাকা প্লাবিত করে। এ জন্য নদী খনন, উপশহরে পানির পাম্পিং স্টেশন করা, ছড়ার সংযোগস্থলে স্লুইস গেট তৈরি ও ড্রেনের প্রশস্ততা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বল্প সময়ে অধিক বৃষ্টির ফলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ সহ্য করতে হয় নগরবাসীকে। স্বল্প সময়ে অতিবৃষ্টি ছাড়াও চা-বাগানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছড়া ও খালের রুগ্ণ দশাও আমাদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে এসব ছড়া ও খাল খননের জন্য সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি।’
জলাবদ্ধতা নিরসন ছাড়াও গতকাল ঘোষিত সিসিকের বাজেটে উল্লেখযোগ্য ব্যয়ের খাতগুলো হলো রাস্তা মেরামত, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, ড্রেন নির্মাণ ও মেরামত, সরঞ্জাম যন্ত্রপাতি ও সম্পদ কেনা, সিটি করপোরেশনের ভবন নির্মাণ ও মেরামত, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ ও সংস্কার, ঢাকায় সিটি করপোরেশনের নিজস্ব লিয়াজোঁ অফিসের জন্য ফ্ল্যাট ক্রয়, কসাইখানা নির্মাণ ও ময়লা আবর্জনা ফেলার জায়গা উন্নয়ন, সিটি করপোরেশনের যানবাহন রক্ষায় গ্যারেজ নির্মাণ, সিটি করপোরেশনের যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণে ওয়ার্কশপ নির্মাণ, হাটবাজার উন্নয়ন, বাস টার্মিনাল সংস্কার ও উন্নয়ন, সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঠাগার নির্মাণ, নাগরিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন প্রভৃতি।