পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫০ বছরের বেশি সময় পর সরাসরি সমুদ্রপথে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। করাচি থেকে একটি কার্গো জাহাজ বুধবার (১৩ নভেম্বর) চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। এই ঘটনাকে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন দিক হিসেবে দেখা হলেও ভারত এতে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের এমন ঘনিষ্ঠতা ভারতের নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলতে পারে। সূত্র: ইত্তেফাক, দ্য মেইল
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি সমুদ্রপথে বাণিজ্য শুরু হওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছে না প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়েছে, পূর্ব ও পশ্চিম প্রতিবেশীর মধ্যে এই নতুন সংযোগ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছে তারা।
চট্টগ্রামে তিন শতাধিক কন্টেইনার নিয়ে আসা কার্গো জাহাজটি নোঙরের সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। তিনি বলেছেন, ‘এই নতুন রুটটি সরবরাহ শৃঙ্খলাকে সহজতর করবে, ট্রানজিটের সময় হ্রাস করবে এবং উভয় দেশের জন্য নতুন ব্যবসায়ের সুযোগ উন্মুক্ত করবে।’
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্র্বতী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সমুদ্রপথে বাণিজ্যকে স্বাগত জানিয়েছে। এতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির আশা প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশর বাণিজ্যের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল।
পাকিস্তান থেকে কার্গো জাহাজটি বাংলাদেশে আনা পণ্যের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও একাধিক সূত্রের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, বাকি চালানগুলো খালাস করার আগে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি বড় কন্টেইনার জাহাজ থেকে নামানো হয়।
‘প্রথমে প্রায় ৪০ ফুট কন্টেইনার নামানো হয় এবং স্থানীয় পুলিশকে দিয়ে সেগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। এটা কোনো স্বাভাবিক নিয়ম নয়। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য প্রবেশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না’ বলেন একটি সূত্র। যিনি আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।
একজন বিশেষজ্ঞের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ এ সম্পর্ক ভারতকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। যদিও তিন মাস আগেও এ উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও মংলা বাংলাদেশের প্রধান দুই বন্দর। গত পাঁচ দশকে এখানে পাকিস্তান জায়গা পায়নি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হতো সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর মাধ্যমে। চট্টগ্রাম ও মংলা বাংলাদেশের দুটি প্রধান বন্দর এবং উভয় বন্দরই পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগের বাইরে রয়েছে। সিঙ্গাপুর বা কলম্বোতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হতো।’
এর ফলে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য আসার শঙ্কা প্রকাশ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখন যেহেতু পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রামে আসবে, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য পাঠানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারেন না।’ ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে অস্ত্র উদ্ধারের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘যা এখনও দক্ষিণ এশিয়ায় অবৈধ অস্ত্রের বৃহত্তম জব্দ করা চালান। সে সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ট্রলারে করে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল উলফার জন্য ১ হাজার ৫০০ চাইনিজ অস্ত্র পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর উলফার হাতে যাওয়ার আগেই জব্দ করা হয়।’
টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া বলছে, মিয়ানমারে এখন টালমাটাল অবস্থা। ভারতের শঙ্কা মিয়ানমার থেকে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং মাদক কারবারি বেড়ে যেতে পারে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সরকারি কোনো সূত্রের কোনো বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি। যদিও দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটিকে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি কার্গো জাহাজের নোঙর করার বিষয়টি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রতীক। এটি পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত জটিল কূটনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতার নতুন দিগন্তের সূচনা করছে।
এদিকে ভারতীয় আরেক গণমাধ্যম দ্য ওয়াল লিখেছে, বাংলাদেশে অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় এসে মহম্মদ ইউনুস দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে নানা চর্চা শুরু হয়েছে। এই জাহাজ আসা তারই অন্যতম প্রথম ধাপ বলে মনে করছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে, ৭১-এর মুক্তযুদ্ধের স্মৃতি কি তাহলে মুছে যাবে ইতিহাস থেকে? তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম: করাচি থেকে এই প্রথম জাহাজ এল চট্টগ্রাম বন্দরে, ইউনুস সরকারের 'পাক প্রেম' কি স্পষ্ট হচ্ছে?
এমনটা হলেও খুব আশ্চর্যজনক কিছু হবে না বলেই মনে করছেন অনেকে। কারণ বাংলাদেশে মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ইতিমধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমানকে 'জাতির পিতা' বলে মানতে নারাজ। ওই স্বীকৃতি কেড়ে নিতে বুধবারই বাংলাদেশ হাইকোর্টে জোর সওয়াল করেন দেশটির প্রধান আইন আধিকারিক তথা অ্যাটর্নি জেনারেল মহম্মদ আসাদুজ্জামান।এর পরে বৃহস্পতিবারই এল পাক জাহাজ।
পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ অবশ্য এই নতুন জলপথকে বাণিজ্যের নিরিখে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন। দু'দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর মতে, এতে দু'দেশের বাণিজ্যের প্রসার হবে, ছোট ব্যবসায়ীদের সুযোগ বাড়বে।
জানা গেছে, এই জলপথে আদতেই আশার আলো দেখছে দুই দেশই। কারণ চাল, পেঁয়াজ, ফলমূলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, এমনকি পোশাকের কাঁচামাল সরাসরি আনা গেলে আর্থিকভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ। আবার পাট-সহ অনেক পণ্যের রফতানিও ত্বরান্বিত হবে।
মাস তিনেক আগে দেশজুড়ে চরম অশান্তির মুখে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা। তার আগে প্রবল অশান্তি তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। এরপর সেখানে তৈরি হয় নতুন অন্তর্র্বতী সরকার, দায়িত্বে মহম্মদ ইউনুস। তার পরেই এই জাহাজ ভেড়ার ঘটনায় রাজনৈতিক তাৎপর্যও দেখছেন অনেকে।