ঢাকা, মঙ্গলবার ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ই পৌষ ১৪৩১

সিলেটি মা: শেষবার চোখে মেলে দেখেছিলেন আমাকে

এমএ রহিম, সিলেট : | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ৭ মার্চ ২০২৪ ০৪:৪৫:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

’তখন বয়স ৭-৮ বছর হবে। প্রতিদিনই মাগরিবের নামাজের সময় নামাজে দাড় করাতেন মা। কিভাবে নামাজ পড়তে হয় তার নিয়ম কানুন শেখাতেন। মায়ের তদারকিতে ওইভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শিখি। এখানেই শেষ নয়। মায়ের কাছে শিখেছি আরবি। আরবি দিয়ে জীবনের প্রথম লেখা পড়া শুরু হয়। প্রথমেই মা আরবি অক্ষর শিখিয়েছিলেন। সেই সাথে শিখিয়েছিলেন দোয়া, কালাম।’

 

সাংবাদিক, লেখক, ছড়াকার মিলু কাশেম (সৈয়দ আবুল কাশেম) মমতাময়ী মা সম্পর্কে ওইভাবে জানান দৈনিক বায়ান্নের কাছে।

 

মিলু কাশেম জানান, আমার বাবা সৈয়দ রাছ উদ্দিন আহমদ। ২০০২ সালের ২২ জুলাই কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। বাবার কর্মজীবনের কারণে কলকাতার সাথে বিশেষ সম্পর্ক ছিল। সেখানকার সাথে অনেক স্মৃতি রয়েছে। তাই বাবা সময় পেলে সেখানে ছুটে যেতে। ২০০২ সালে একই কারণে বাবা গিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি ডাক্তাররা। মৃত্যুর পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত বাবা বহুমুখি ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। মা সৈয়দা দয়া বেগম ছিলেন গৃহিনী। আমরা ১০ ভাই বোনকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কারিগর। সকল বিপদ আপদ থেকে আগলে রেখে গড়ে তুলেছেন আমাদের। ১৯৮৮ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমার ছোট নয় ভাই বোন হলো সৈয়দ আবুল মনসুর লিলু যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ী, লেখক ও একাউন্টটেন্ট। অধ্যাপক সৈয়দ আবু জাফর হিরু যুক্তরাজ্য প্রবাসী ও কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। দিলু নাসের সৈয়দ আবু নাসের যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছড়াকার, লেখক, সাংবাদিক, উপস্থাপক। লন্ডনের অধুনালুপ্ত পূর্বদেশের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। এখন সরকারি জব করেন। বোন সৈয়দা ফাহিমা খাতুন রিপা-গৃহিনী। বোন সৈয়দা ফাতেমা চৌধুরী শিল্পী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। সৈয়দ আবুল মহসিন লিটু-যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ী। সৈয়দা ফাহমিদা খাতুন লিপি গৃহিনী। সৈয়দা ফারজানা খাতুন পলি গৃহিনী। সৈয়দ মঞ্জুর আহমদ মঞ্জু দেশে ব্যবসা করেন।  

 

 

তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে। বাবা লেখা পড়া করার জন্যে সুনামগঞ্জ শহরে চলে যান। সেখানে লেখা পড়া শেষে আদালতে চাকরি পেয়ে যান। পরে পারিবারিকভাবেই বিয়ে করেন। বিয়ের পর সুনামগঞ্জ শহরের ঘোলঘরে বসবাস শুরু করেন। এখানেই আমার জন্ম হয় ১৯৫৮ সালে। আমি সংসারের বড় সন্তান। এই ঘোলঘরে আমার আরো তিন ভাইয়ের জন্ম হয়েছে।’

 

মিলু কাশেম জানান, ‘১৯৬৫ সালে সুনামগঞ্জের লঞ্চঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সংসারের প্রথম সন্তানের স্কুলে যাতায়াতে বিশেষ নজরদারি ছিল মা-বাবাবর। অনেকদিন বাবার হাত ধরে স্কুলে পৌঁছতাম। স্কুল ছুটির পর আমাদের পরিচিত একটি রিকশায় করে বাসায় ফিরতাম। সেসময় আমার ২জন বন্ধু ছিল। তারা হলেন এডভোকেট পীর মতিউর রহমান ও অধ্যক্ষ সৈয়দ মুহিবুল ইসলাম। তাদের বাসা ছিল আমাদের বাসার পাশে। অনেকদিন আমরা তিন বন্ধু মিলে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরতাম। স্কুলে যাওয়ার সময় পরিপাটি করে সাজিয়ে দিতেন মা। বাসায় ফিরে দেখতাম মা ছোট তিন ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত। অনেকদিন দেখেছি মা দরজার সামনে দাড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছেন। আমি বাসায় ফেরার পর আমরা চার ভাইকে খাওয়াতেন। খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুম পাড়াতেন।’

 

তিনি জানান, ‘শৈশব থেকে দেখেছি মা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। সাত সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন। ফজর নামাজ শেষে নাস্তা তৈরি করতেন। নাস্তা শেষে বাবাকে অফিসের উদ্দেশ্যে বিদায় করতেন। আমরা চার ভাইকে পরিপাটি করে নাস্তার টেবিলে বসাতেন। সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটাতেন  সংসার নিয়ে। সন্ধ্যার পর আমাকে আরবি পড়াতেন। পরে বাংলা।  রাত ৮ টার মধ্যে লেখাপড়া ও খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। মশারি টানিয়ে দিতেন মা। অফিসের কাজে বাবা অনেকদিন রাতে ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন। ফিরতেন গভীর রাতে। মা ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।’

 

মিলু কাশেম বলেন, ‘আমাকে পড়ানোর জন্যে কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না। মা ছিলেন আমাদের গৃহশিক্ষক। আরবি, বাংলা ও ইংরেজি পড়াতেন মা। যদিও মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন একটা ছিল না। তিনি ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন। কিন্তু হাতের লেখা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। শৈশব থেকে মা ধর্মীয় অনুশাসনে বড় হয়েছিলেন। কারণ আমার নানা বৃটিশ জাহাজে চাকরি করতেন। জাহাজেই মৃত্যু হয়েছে নানার। ফলে জন্মের পর নানাকে দেখেননি মা। মা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছিলেন পিতৃহীন অবস্থায়।’

 

 

তিনি বলেন, ‘মা ছিলেন অতিথি পরায়ণ। গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ বেড়াতে এলে খাতির যতেœর কমতি হতো না। সুনামগঞ্জের জুবিলি হাইস্কুলে সৈয়দপুরের কয়েকজন ছাত্র লেখাপড়া করতেন। তারা থাকতেন হোস্টেলে। এদের অনেকেই প্রায় সময় আমাদের বাসায় আসতেন। তাদেরকে পেয়ে মা অনেক খুশি হতেন। নানান ধরণের খাবারের আয়োজন করতেন তাদের জন্যে। মাঝে মধ্যে বাসায় ভালো রান্না হলে বা পিঠা তৈরি হলে মা ওইসব ছাত্রকে খবর দিয়ে আনতেন। আপ্যায়ন করতেন। মায়ের আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে ওইসব শিক্ষার্থীর আনাগোনা লেগে থাকত। এতে আমার সুবিধা হয়েছিল। তাদের সাথে শহর ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেতাম। ওইসব শিক্ষার্থীদের অন্যতম দুইজন হলেন সৈয়দ আলী আহমদ ও সৈয়দ আতাউর রহমান। তারা প্রায়দিন আমাকে পড়াতেন। এতে অনেক খুশি হতেন মা।’

 

 

মিলু কাশেম বলেন, ১৯৬৬ সালে আমার বাবা সৈয়দ রাছ উদ্দিন আহমদ চাকরি ছেড়ে সিলেট শহরে চলে আসেন আমাদের সবাইকে নিয়ে। আমাকে ভর্তি করা হয় দরগাহ মহল্লার জালালিয়া প্রাইমারি স্কুলে। সিলেট শহরের আম্বরখানার বড়বাজারে বাড়ি ক্রয় করেন বাবা। এই বাড়িটির নামকরণ হয় বনানী ভবন। বাড়ি তৈরির জন্যে কিছুটা সময় লাগছিল। ওই অবস্থায় বাবা আমাদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। এখানে আমার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়। এক বছর পর আবার শহরে ফিরে আসি। উঠি আমাদের নিজস্ব বাড়িতে।’

 

 

মিলু কাশেম বলেন, ‘সিলেট শহরের রাজা জিসি হাস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত এখানেই লেখাপড়া করি। পরে ১৯৭২ সালে ভর্তি হয় দি এইডেড হাইস্কুলে। এখান থেকে এসএসসি পাস করি। পরে ভর্তি হই সিলেট সরকারি কলেজে। জড়িয়ে পড়ি রাজনীতিতে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পরার পর জীবনে নেমে আসে ঝড় তুপান। ১৯৭৭ সালে গ্রেফতার হই। এসময় চলছিল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। এই গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে অনেক কষ্ট দিয়েছি মাকে। তিন মাস কারাবন্ধি ছিলাম। এই তিন মাস জায়নামাজে বসে চোখের পানি ফেলেছেন মা। বাবার অগ্নিমূর্তি আর আমার বন্দি জীবনের কারণে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েন মা। কয়েকদিন পরপর মা কারাগারে যেতেন আমাকে দেখার জন্যে। মায়ের সঙ্গি হতো ছোট বোন। তিন মাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অনেকদিন বাবার সামনে যাইনি। এনিয়ে মাকে প্রতিদিন শাসাতেন বাবা। একদিন আমাকে ডেকে বাবা জানালেন কারাগার থেকে মুক্ত করতে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কেউ একটি টাকা দিয়েও সহযোগিতা করিনি। বাবা জারি করলেন শাসন। ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। কিন্তু জিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেত রাস্তায় থাকতে হবে। গভীর রাত পর্যন্ত সহযোগিদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াতাম। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতাম। ছড়া আর কবিতা লিখে প্রতিবাদ করতাম। এজন্যে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে আমার মাকে। যখন তখন পুলিশ অভিযান চালাতো। দুর্ব্যবহার করত। একদিন আমাকে ধরে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়। গভীর রাতে বাসায় ফিরতাম। আমার ঘরের একটি গোপন জানালা ছিল। ওই জানালায় টোকা দেয়া মাত্র কৌশল করে মা তা খুলে দিতেন।’

 

 

মিলু কাশেম জানান, ‘আমার পরিবারের সদস্যরা আমাকে নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেন। বিশেষ করে মায়ের চোখের পানি যেন শুকাতে চায় না। ওই অবস্থায় ১৯৭৮ সালে আমি পাড়ি জমাই নেদারল্যান্ডে। সেখানে গিয়ে ফুল ও ফল চাষের উপর ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করি। সেখান থেকে পাড়ি জমাই জার্মানিতে। সেদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করি। এ নিয়ে শুরু হয় আইনি লড়াই। দীর্ঘ ৮ বছর আইনি লড়াই করে কোনো ফল পাচ্ছিলাম না। এদিকে বাড়ি থেকে বারবার খবর যাচ্ছিল মায়ের অবস্থা ভালো নয়। আক্রান্ত হয়েছেন জটিল রোগে। দেশে ফেরার চেষ্টা চালাই। কিন্তু মামলা চলা অবধি দেশে ফেরা যাবে না। ওই অবস্থায় সেখানকার একটি পরিবার আমার দায়িত্ব নিলেন। সেদেশের সরকারকে ওই দায়িত্বের কথা জানিয়ে এক বছরের ভিসার ব্যবস্থা করেন পরিবারটি। দেশে ফিরে আসি ১৯৮৮ সালে।’

 

তিনি জানান, ‘দেশে ফিরে মায়ের চিকিৎসায় ছুটতে থাকি। কিন্তু জটিল রোগ। নিরাময়ের কোনো সুযোগ নেই। এদিকে জার্মান থেকে ফেরার সময় কিছু মালামাল কার্গো করেছিলাম। ওই মালামাল আনতে ঢাকায় যেতে হয়। ঢাকায় যাওয়ার পর বাড়ি থেকে খবর পাই-মায়ের অবস্থা ভালো না। বারবার আমাকে খুঁজছেন। ছুটে আসি বাড়িতে। ভর্তি করি হাসপাতালে। হাসপাতালের শয্যায় আমার দিকে একবার তাকিয়েছিলেন মা। তার পর চিরদিনের জন্যে চোখ বন্ধ হৃয়ে যায় মায়ের।