গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিজয়ের অংশ হয়েও নতুন বাংলাদেশের আলো দেখা হচ্ছে না পুলিশের ছররা গুলিতে চোখ হারানো শরীয়তপুরের কিশোর মবিন হোসেনের । সহযোদ্ধারা যখন বিজয় উৎসবে মাতোয়ারা রাজপথে, তখন চোখে অনন্ত অন্ধকার নিয়ে মবিন কাতরাচ্ছে বাড়িতে।
শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার বড় সিধুলকুড়া গ্রামের মৃত মোফাজ্জল হোসেনের ছেলে মবিন হোসেন ঢাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখন বাড়িতে আছেন। টাকার অভাবে বাকী চিকিৎসাও করতে পারছে না । চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শটগানের শতাধিক ছররা গুলি লেগেছে হিমেলের মাথা ও মুখমণ্ডলজুড়ে। গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত তার চোখে স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি আর ফিরবে কি-না তা এখনো অজানা । এখনও কয়েকটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। কবে সুস্থ হবে, তা নিশ্চিত নয়।
মবিনের বাবা মোফাজ্জল হোসেনের মৃত্যুর চার মাস যেতে না যেতেই আরও একটি শোকের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তার মা নাজমা বেগম। তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড়ো ছেলে বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী জুলহাস। তাকে নিয়ে মা নাজমা বেগমের যত চিন্তা। হঠাৎ করে আরও একটি মহা চিন্তা যুক্ত হলো বিধবা নাজমা বেগমের।স্বামী মারা যাবার পর টাকার অভাবে ছোট ছেলে মবিন কে ঢাকার উত্তরায় একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজে পাঠায়। এখানেই ঘটে বিপত্তি, গত ১৮ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারা দেশ যখন উত্তাল। মিছিলে মিছিলে রাজপথ ছিল প্রকম্পিত। এ অবস্থায় কিশোর মবিন আর দোকানে থাকতে পারেনি। সকাল ১১ টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি একপর্যায়ে উত্তরা থানার দিকে গেলে থানার ভিতর থেকে শুরু হয় গুলি। পুলিশের ছর্রা গুলিতে তাঁর মাথা ও চোখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুবিন। এরপর থেকে বিভীষিকাময় প্রতিটি সময় পার করছেন কিশোর মুবিন ও তাঁর পরিবার।
শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার শিধলকুড়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের বড় শিধলকুড়া গ্রামের মৃত মোফাজ্জল হোসেন ও নাজমা বেগম দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট ছেলে মবিন(১৭)। বাবার মৃত্যুর পরে মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে ও প্রতিবন্ধী ভাইটি কে সুখে রাখতে উত্তরার রাজলক্ষ্মীর পাশে ৩ নাম্বার সেক্টর ২ নাম্বার রোডের ২৭ নাম্বার প্লটে লতিফ এম্পোরিয়ামের মো: ওয়াসিম তালুকদারের ইজি কম্পিউটার সেন্টারে চাকরি নেয়।
কোটা বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ ও ডান কান নষ্ট হয়ে যায় মবিনের। ধারদেনা করে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে চোখের চারটি অপারেশন করিয়ে রীতিমত পথে বসে গেছে তার পরিবার। সামনে তাঁর আরও দুটি অপারেশন করাতে প্রয়োজন অনেক টাকার। কোথায় পাবে বিধবা নাজমা বেগম এতগুলো টাকা? স্বামীর রেখে যাওয়া ভাঙ্গাচুরা ঘর আর ভিটেমাটিই এখন তাঁর শেষ সম্বল ।
কথা হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ ও এক কান হারানো মবিনের সাথে। তিনি নিজের মুখে বর্ননা দেন তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতম ঘটনার।
মবিন জানান,প্রতিদিনের মতো ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে কাজের জন্য দোকানে যায়। দোকানে ঢোকার কিছু সময় পরেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিল বের হয়। তখন মবিন দোকান বন্ধ করে ছাত্রদের সাথে মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি উত্তরা থানার সামনে গেলে, থানা থেকে মিছিলটি লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়তে থাকে পুলিশ। পুলিশের ছররা গুলিতে তাঁর মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যায় এবং তার কানে ও চোখে অনেক গুলি লাগে । তখন সে মাটিতে পরে যায়। কয়েকজন আন্দোলনকারী তার গায়ে থাকা গেঞ্জি খুলে মাথা বেধে প্রথমে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
মবিনের ভাই নাজমুল হুদা পলাশ বলেন, গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার আমি বাসাতেই ছিলাম। সকাল সাড়ে ১১ টায় আমার মোবাইলে ফোন আসে। আমাকে বলে আপনি কি মবিনের ভাই পলাশ। আমি হ্যা বলতেই তিনি বলেন, আপনি দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চলে আসুন আপনার ছোট ভাই মবিন পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। আমি তখন দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে অনেক খোঁজা খুঁজি করে আমার ভাই কে পাই। তখন ওর সমস্ত মাথা সাদা কাপড়ে মোড়ানো। চেহারার দিকে তাকাতেই আমার হৃদয় আঁতকে উঠল।
এরপর ডাক্তার বললেন, ওকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে ভালো চিকিৎসা হবে। তখন এম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাই। ওখানে বেশ কয়েক দিন চিকিৎসা শেষে চোখের অপারেশন করাতে ভিশন আই হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওখানেও ওর বেশকয়েকটি অপারেশন হয়। ভিশন আই হাসপাতালে আমাদের এক লাখ বিশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এখন আমাদের কাছে ওর চিকিৎসার জন্য কোন টাকা নেই। শুধু বাবার রেখে যাওয়া টিনের ঘর ও একটু জমি শেষ সম্বল। এটা বিক্রি করে দিলে আমার মা ও তিন ভাই মিলে খোলা আকাশের নিচে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এখন সরকার ও দেশবাসী যদি আমার ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য সহায়তা করে, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হয়।
মবিনের মা নাজমা বেগম বলেন, ওর বাবা মরার চার মাসের মাথায় আল্লাহ আমাকে আরও একটা শাস্তি দিল। আমার বড়ো ছেলেটা প্রতিবন্ধী ওর দেখা শোনা করতেই হিমশিম খাই। এখন আবার ছোট ছেলে পুলিশের গুলিতে চোখ দুটি নষ্ট হয়ে যায় এবং ডান কানেও শুনে না। আমি এখন দুই প্রতিবন্ধী নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব।
অভাবের সংসারে কষ্ট করে মেঝো ছেলে কে আইএ পাশ করাইছি এখন সরকার যদি আমার এই ছেলেকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে তাহলে হয়তো দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারবো।