‘মাকে ঘিরেই আমার সকল স্বপ্ন, সাধনা আর এগিয়ে চলা। মায়ের সানিধ্য ছাড়া সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। সেই শৈশব থেকে মায়ের আঁচল ধরে হেঁটে চলেছি। আজো সেই ধারা অব্যাহত আছে। মায়ের বয়স অতিক্রম করেছে একশ বছর। চলাফেরায় অনেক কষ্ট হয়। তারপরও মায়ের আঁচল ধরে হাঁটতে ইচ্ছে হয়। সুযোগ হলে তা হাতছাড়া করি না। নানান ছলচাতুরী করে মায়ের পায়ের কাছে বসি। অনেক সময় শুয়ে পড়ি। মা দুই হাত তুলে ধরেন মহান সৃষ্টি কর্তার প্রতি। প্রাণভরে দোয়া করেন। আল্লাহর হাওলা করে দেন। এই হলো আমার মা। মাকে নিয়ে অনেক অনেক স্মৃতি। জীবন গড়ার জন্যে ধর্মীয় উপদেশ আজো মায়ের কন্ঠ থেকে দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত হয়। যা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম লিয়াকত আলী মমতাময়ী মায়ের ¯েœহ, মায়া, মমতা, শাসন, আদর্শ সম্পর্কে জানান দৈনিক বায়ান্নের কাছে। এম লিয়াকত আলী তামাবিল চুনাপাথর, পাথর ও কয়লা আমদানিকারক গ্রæপের সভাপতিও। জৈন্তাপুর উপজেলার ২ নম্বর জৈন্তাপুর ইউনিয়নের বাউরভাগ গ্রামে জন্ম এম লিয়াকত আলীর। পিতা ওয়াজেদ আলী ছিলেন কৃষক। পাশাপাশি নিয়োজিত ছিলেন ব্যবসায়। তিনি এখন বেঁচে নেই। মা ফুলজান বিবির বয়স একশ বছর অতিক্রম করেছে। এম লিয়াকত আলীর বড় ভাই মোহাম্মদ আলীও বেঁচে নেই। ছোট ভাই মুসলিম আলী একজন ব্যবসায়ী। ছোট বোন ছুরুতুন নেছা স্বামীর সংসারে।
শৈশবে মায়ের আদর যতœ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এম লিয়াকত আলী বলেন, যখন বুঝার ক্ষমতা হয়েছে তখন থেকে দেখে আসছি মায়ের ভালোবাসা। অন্যায় করলে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো। ভালো করলে আদর যতেœ কাছে টেনে নিতেন।
তিনি বলেন, মা অত্যন্ত পরহেজগার এক নারী। উপযুক্ত বয়স হওয়ার পর আমাদের সকল ভাই বোনকে সকালে বাধ্যতামূলক মক্তবে যেতে হতো আরবি পড়ার জন্যে। যদিও মা নিজেও আমাদেরকে আরবি শিক্ষা দিয়েছে। প্রথম অবস্থায় মায়ের কাছে আরবি অক্ষর শিখেছি। ভোররাতে মা ঘুম থেকে উঠেন। ফজর নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে জাগিয়ে তুলতেন আমাদেরকে। নামাজ পড়ার যোগ্য ভাই বোনকে নামাজ পড়তে তাগাদা দিতেন। নামাজ শেষে মা নাস্তা তৈরি করতেন। নাস্তা বলতে বিরন ভাত (ভাত ভাজি) আর সবজি বা মাংস রান্না করতেন। অনেকদিন আবার খিচুরিও তৈরি করতেন। নাস্তা শেষে সবাইকে মক্তব্যে পাঠিয়ে দিয়ে মা রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। মক্তব থেকে ফিরে মায়ের রান্না করা খাবার খেয়ে স্কুলের পথে পা বাড়াতাম। মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাতেন। অনেকদিন কপালে চুমো দিয়ে দিতেন। কেউ পেটে ব্যথা বা মাথা ব্যথার কথা বললে মা দোয়া পড়ে ফু দিতেন। ফু দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনো হতো ব্যথা নেই। এই ফু দেয়ার বিষয়টি শুধু স্কুলে যাওয়ার সময় ছিল না। অন্য সময়ও মা ফু দিলে মাথা আর পেট ব্যথা ভালো হয়ে যেত।
লিয়াতক আলী জানান, স্কুল শেষে বাসায় বাড়ি ফিরে দেখতাম মা অপেক্ষা করছেন। খাবার আয়োজন করে রেখেছেন। বইপত্র রেখেই খাবার ঘরে যেতাম। মাদুর বিছিয়ে সবাই খেতে বসতাম। খাবার শেষে খেলার মাঠের উদ্দেশ্যে দৌড়াতাম। এসময় পেছন থেকে অনেক ডাকাডাকি করতেন মা। কিন্তু থামাতে পাড়তেন না। মাগরিবের নামাজের আজানের সাথে সাথে বাড়ি ফিরতাম। নামাজ শেষে প্রথমে আরবি পড়া নিয়ে বসতাম। এসময় আরবি পড়াতেন মা। সকালে মক্তবে গিয়ে কি পড়েছি-তাও জেনে নিতেন। আরবিতে মা অত্যন্ত পারদর্শী। একশ বছর অতিক্রম করার পর আজো চশমা ছাড়া কোরআন পড়েন মা। নামাজ শিখিয়েছেন মক্তবের হুজুরের পাশপাশি আমাদের প্রিয় মা।
তিনি বলেন, রাত ৯ টা বা ১০ টা পর্যন্ত বাংলা লেখা পড়া শেষে রাতের খাবার শেষ করতাম। তারপর ঘুমাতে যেতাম। আমরা ভাইবোনেরা ঘুমিয়েছি কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার পর ঘুমাতে যেতেন মা। অনেক সময় শেষ রাতে মা তাহজুদ নামাজে নিজকে মগ্ন করে দিতেন।
মায়ের ধর্মজ্ঞান ও শাসন সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিয়াকত আলী বলেন, মা যেভাবে আদর করতেন ঠিক একইভাবে শাসন করতেন। তবে শাসনের ধরণটা ছিল ভিন্ন। ধমক ছাড়া কোনোদিন বেতের আঘাত করেননি। ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে মা বলতেন অন্যের ক্ষতি করলে তা নিজের উপর ফিরে আসে। কারো হক নষ্ট করলে তা কিয়ামতের দিন পরিশোধ করতে হবে। মনে কষ্ট দিলে অভিশাপের বোঝা বহন করতে হয়। অভিশাপ নিয়ে কেউ এগিয়ে যেতে পারেন না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মা যখন পরামর্শ দিতেন-তা আমরা সহজেই গ্রহণ করতাম।
তিনি জানান, শৈশব থেকে তার একটি অভ্যাস রয়েছে। মা যখন নামাজ পড়তে জায়নামাজ বিছাতেন তখন তিনি মায়ের জায়নামাজের এক পাশে গিয়ে শুয়ে পড়তেন। মা এতে কোনো ধরণের বাধা দিতেন না। এক পাশে দাঁড়িয়েই মা নামাজ পড়তেন। নামাজ শেষে মা মুনাজাতের জন্যে হাত উঠাতেই গলায় জড়িয়ে ধরে দোয়া করতে বলতেন। চোখের পানি ফেলে উচ্চ কন্ঠে দোয়া করতেন মা। আল্লাহর হাওলা করে দিতেন।
লিয়াকত আলী জানান, মা মনে প্রাণে চাইতেন আমি যেন জনসেবক হই। বিভিন্ন সময় এর প্রমাণও পেয়েছেন। বিশেষ করে মুনাজাতে মা সেই কামনা করতেন।
মা কেন এমনটি চাইতেন জানতে চাইলে লিয়াকত জানান, শৈশব থেকেই তিনি অন্যকে সহযোগিতা করতে ভালোবাসতেন। কোনো কারণে মা টাকা দিলে তার অধিকাংশই বিলিয়ে দিতেন। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে তাদেরকে নিয়ে দোকানে যেতেন। বাকিতেই তাদের হাতে নানান ধরণের খাবার তুলে দিতেন। বাকির ওই টাকা পরে পরিবার থেকে পরিশোধ করা হতো। এনিয়ে কোনোদিন বিরক্ত হননি মা। আগুন মাসে (অগ্রহায়ণ) অনেক ধান উঠত। বর্গা চাষিরা ওই ধান ফলাতেন। বিনিময়ে তারা নিদির্ষ্ট ভাগ পেতেন। কিন্তু বর্গা চাষিরা ভাগের ধানের চেয়ে অতিরিক্ত ধান পেতেন লিয়াকত আলীর বদৌলতে। তিনি বর্গা চাষিদেরকে অতিরিক্ত ধান দিয়ে দিতেন। এসব বিষয় সব সময় পর্যবেক্ষণ করতেন মা। যার জন্যে মা আজো প্রার্থনায় বলে থাকেন তিনি যেন জনসেবক হন। চেয়ারম্যান হন। এমপি হন। সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে কমপক্ষে ৫ বার ডাক দেন মা। বারবার ফিরে গিয়ে মায়ের আঁচলের ধরে দাঁড়াই। মা দুই হাত তুলে দোয়া করেন। কর্মক্ষেত্রে হতাশ হলে মায়ের চোখে তা ধরা পড়ে। কাছে ডেকে হতাশ না হওয়ার জন্যে বলেন। হতাশ হলে ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে বলে জানিয়ে দেন।
তিনি বলেন, আমার বয়স অনেক হয়েছে। কিন্তু মায়ের কাছে যেন সেই শিশুটি রয়ে গেছি। যখন তখন খবরদারি করেন। কাছে ডেকে নানান ধরণের পরামর্শ দেন। এসব পরামর্শ থাকে ধর্মীয় বিধানমত। মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এই হাতে যে শান্তি পাওয়া যায়, তা পৃথীবির শ্রেষ্ট শান্তি। এমন শান্তি আর কোথায়ও পাওয়া যায় না।