দেশের চতুর্থ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৮ সালে কার্যক্রম শুরু হয় সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্য দক্ষিণ সুরমায় ১০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তবে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালুর আগেই বড় ধরনের অনিয়মে জড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদিত পদের বাইরে অতিরিক্ত ১০৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অস্থায়ীভাবে দেওয়া এসব নিয়োগে উপাচার্যের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সাংসদের স্বজনেরা রয়েছেন। এমনকি উচ্চশিক্ষার অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বে থাকা ইউজিসির কর্মকর্তাদের সুপারিশেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনুষদে বেআইনিভাবে আটজনকে ডিন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে ইউজিসির তদন্তেই।
ইউজিসির তদন্ত কমিটি সুপারিশ করেছে, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ীভাবে (অ্যাডহক) যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের মেয়াদ আর না বাড়ানো, অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পাওয়ার পরও নীতিমালা লঙ্ঘন করে যাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করা এবং পদোন্নতির পর পাওয়া অতিরিক্ত বেতন-ভাতার অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়া।
এবারই প্রথম ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। এ চিঠিতে অনিয়ম বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী বা অস্থায়ী পদে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে ইউজিসির প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সদস্যকে এবং কর্মকর্তা–কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডে ইউজিসির সচিবকে পর্যবেক্ষক হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য ও ইউজিসির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফেরদৌস জামান চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠিত হয় স্নাতকোত্তর চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এটি দেশের চতুর্থ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৮ সালের নভেম্বরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টির নিজস্ব ক্যাম্পাস হয়নি। সিলেট শহরের চৌহাট্টা এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য শহরের পাশে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের নভেম্বরে ইউজিসি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দের নেতৃত্বে কমিটিতে ছিলেন ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান ও উপপরিচালক মৌলি আজাদ (সদস্যসচিব)। কমিটি নিয়োগ–বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্ত করতে গত ১৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। উপাচার্যসহ ২১ জনের সাক্ষাৎকার নেন তাঁরা এবং তদন্তসংশ্লিষ্ট নথি সংগ্রহ করেন।
ইউজিসি বলছে, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন কর্মরত জনবল আছে ১৭৪ জন। ইউজিসি থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১১২টি পদের অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে অনুমোদিত সব পদে এখনো নিয়োগ হয়নি। তদন্ত কমিটি প্রমাণ পেয়েছে, ১০৯টি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। তাঁদের বেতন–ভাতার অর্থ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান হিসেবে দেওয়া হয় বলে তদন্ত কমিটিকে বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার।
কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ১০৯ জনের বেতন–ভাতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুদান থেকে আসছে, এমন কোনো তথ্য–প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেনি।
তদন্ত কমিটির কাছে উপাচার্য মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন, তাতেই তার আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উপাচার্যের শ্যালকের স্ত্রী ফাহিমা খানম চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক পদে, উপাচার্যের স্ত্রীর বড় ভাইয়ের ছেলে গাজী মো. ফারাজ জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ জেবুন্নেসা হকের ছেলেও নিয়োগ পেয়েছেন বলে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন উপাচার্য।
ইউজিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির শীর্ষ পর্যায়ের আরও কয়েকজন কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজনকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইউজিসির একজন সদস্যের অফিস সহকারীর ভাই এবং ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের একজন কর্মকর্তার শ্যালকসহ অন্তত তিনজনকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীর আত্মীয়ও নিয়োগ পেয়েছেন বিভিন্ন পদে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগসংক্রান্ত অনিয়মের তদন্তে ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের কর্মকর্তাদের একই ধরনের সুপারিশের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, যা ক্ষমতার অপব্যবহার।
উপাচার্য তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, তিনি যখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, তখন কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না। পরে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) মো. নঈমুল হক চৌধুরীকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
নঈমুল হক চৌধুরী এখন বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রারের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। উপাচার্য তদন্ত কমিটিকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন তিনি রেজিস্ট্রারের (অতিরিক্ত দায়িত্বে) কথা অনুযায়ী বিভিন্ন নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করতেন। মূলত রেজিস্ট্রার নিজের দায় এড়িয়ে উপাচার্যের ওপর দায় বর্তানোর জন্য এ কাজ করতেন বলে প্রতীয়মান হয় বলে তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অনুষদের অস্তিত্ব বা কার্যক্রম দৃশ্যমান না হলেও আটজন ডিন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে ডিন নিয়োগ করা এবং তাদের সিটিং অ্যালাউন্স বা যেকোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদান করা সম্পূর্ণ অবৈধ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে উপাচার্য বা সিন্ডিকেটকে ডিন নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, প্রয়োজন হলে ইউজিসির মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে একজন ডিন নিয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া ডিন হিসেবে আটজনের নেওয়া আর্থিক সুবিধার প্রাপ্ত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিতে বলা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ইউজিসি ১৭ জানুয়ারি উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে বলেছে অস্থায়ীভাবে আর কোনো নিয়োগ না দেওয়া। আর যেসব পদে ইতিমধ্যে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের চাকরির মেয়াদ আর না বাড়িয়ে ইউজিসির অনুমোদিত পদের বিপরীতে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, কলেজ পরিদর্শক, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, পরিচালক (অর্থ ও হিসাব বিভাগ), পরিচালকসহ (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) গুরুত্বপূর্ণ পদে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে বলে ইউজিসি। এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে অস্থায়ী, খণ্ডকালীন, অতিরিক্ত দায়িত্ব বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ গ্রহণযোগ্য নয়।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান এ বিষয়ে বলেন, শুধু সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, নতুন আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ আছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনিয়ম আরও বেড়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ–বাণিজ্য হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত পদের বাইরে মাত্রাতিরিক্ত পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আবার কখনো যোগ্যতা ছাড়া বা যোগ্যতার মাপকাঠি শিথিল করে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এগুলোর কোনোটাই কাম্য নয়। এসব ঘটনা দেশের প্রচলিত আইনেও গর্হিত অপরাধ। যারা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে।