পেশায় ফটোকপি দোকানের কর্মচারী আরিফ ব্যাপারী (২০)। প্রথমে নিজের আয়ের টাকায় জাল টাকা তৈরির মেশিন কেনেন। এরপর রাজমিস্ত্রি অনিক ও পদ্মা নদীর জেলে জাহিদকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন জাল টাকা তৈরির চেষ্টা।
ইউটিউব দেখে দেখে দীর্ঘদিন চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে সফল হন তারা। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে কম দামে জাল টাকা বিক্রির পোস্ট দিয়ে সংগ্রহ করেন ক্রেতা। ৭-৮ দিন আগে তারা ১২ লাখ টাকার একটি জাল নোটের চালান সরবরাহ করেন। এখান থেকে তারা আয় করেন দেড় লাখ টাকা।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে জাল টাকা চক্রের এই তিন সদস্যকেই গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। র্যাব বলছে, ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল চক্রটি।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন জালনোট তৈরি ও ব্যবসায়ী চক্রের হোতা মো. আরিফ ব্যাপারী (২০), তার অন্যতম প্রধান সহযোগী ও চক্রের সক্রিয় সদস্য মো. জাহিদ (২৩) ও অনিক (১৯)।
বুধবার (২৭ মার্চ) রাতে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার দুর্গম চরমোহনসহ আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ লাখ টাকার সমপরিমাণ জাল নোট ও জাল টাকা তৈরিতে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, প্রিন্টারসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতিসহ তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দন আহমেদ।
১ লাখ টাকার জাল নোট ১৫ হাজারে বিক্রি
তিনি বলেন, নড়িয়া থানার ঘড়িষাঁড় ইউনিয়নের বাংলা বাজারে একটি কম্পিউটার দোকানে কাজ করতেন আরিফ। তিনি ইউটিউব থেকে জালটাকা বানানোর প্রক্রিয়া দেখে এবং নিজের কম্পিউটার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জাল নোট তৈরি শুরু করে। আরিফ জাল টাকা ছড়িয়ে দিতে জাহিদ ও অনিককে সহযোগী হিসেবে নেন। এরপর তারা মিলে জালটাকা ছাপানোর কাজ শুরু করে। তাদের তৈরি করা টাকা অনলাইনের বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে বিক্রির পোস্ট দিতেন। তাদের এই পোস্ট বুস্টিংয়ের মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতা সংগ্রহ করতেন।
ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে বিপুল পরিমাণ জাল নোট বাজারে সরবরাহের করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তারা প্রতি ১ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। ঈদ উপলক্ষ্যে জাল নোটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তারা প্রতি ১ লাখ টাকার জাল নোট ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি শুরু করেন।
লে. কর্নেল আরিফ বলেন, রাজধানীর বাংলা বাজারের বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করা বেশিরভাগ লোক শরীয়তপুর জেলার। ফলে আরিফের পরিচিতদের সূত্র ধরে সে বিভিন্ন সময় রাজধানীর বাংলা বাজারে এসে অবস্থান করে প্রিন্টিং সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে। সেই ধারণা থেকেই জাল টাকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন রং, কালি ও কাগজ পুরান ঢাকা কিনে নেয়।
হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, ইমোতে যোগাযোগ
তৈরি করা জালনোটগুলো বিক্রির জন্য আরিফ, জাহিদ এবং অনিক মিলে ফেসবুকে জালটাকা বিক্রির বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপের (যেমন- এ গ্রেড জালনোট, টাকা চাই, জালনোট, জাল টাকা বিক্রি করি, জাল টাকার ডিলার, জাল টাকা বিক্রির কেন্দ্র, রিয়েল সেলস, টাকা বিজনেস ইত্যাদি) পোস্টে জাল টাকা কিনতে আগ্রহী কমেন্টকারীদের সঙ্গে ভুয়া আইডি খুলে ইনবক্সে যোগাযোগ করে। পরে তারা হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, ইমোতে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রাথমিক যোগাযোগের পর সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে জাল টাকা ডেলিভারির দিতেন।
চক্রটি গত কয়েক মাসে জাল টাকার একাধিক বড় চালান ডেলিভারি দিয়েছে। চক্রটি ৫ লাখ টাকার জাল নোট ডেলিভারির জন্য প্রস্তুতিকালীন টাকা, মেশিন ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদিসহ র্যাবের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েন। তারা রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর এলাকায় জাল নোট সরবরাহ করতেন বলে স্বীকার করেছে।
গ্রেপ্তারদের বর্ণনা দিয়ে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, আরিফ এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তিনি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার বাংলাবাজারে একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করতেন। দোকানের কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করতেন সে টাকা জমিয়ে জাল নোট ছাপানোর জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনেন।
পরবর্তীতে তিনি তার ঘরে কম্পিউটারের দোকানের কাজের আড়ালে জাল নোট ছাপানোর কাজ শুরু করেন। তার জালনোট ছাপানোর কাজে অন্যতম সহযোগী হিসেবে জাহিদ এবং অনিক সহযোগিতা করতেন। তারা জালনোট বিক্রি করে যে টাকা পেতেন তার অর্ধেক আরিফ নিতেন এবং বাকি অর্ধেক জাহিদ ও অনিক পেতেন।
গ্রেপ্তার জাহিদ নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। ২০২১ সালে সৌদি ফেরত জাহিদ পদ্মা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। কিন্তু অল্প পরিশ্রমে অধিক অর্থের আসায় মাছ ধরার আড়ালে আরিফের সাথে জালনোট ছাপানোর কাজ শুরু করেন। সে জালনোট বিক্রির জন্য বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপে পোস্ট করে কাস্টমার সংগ্রহ করতেন।
গ্রেপ্তার অনিক পেশায় রাজমিস্ত্রি। তিনি এ পেশার আড়ালে আরিফ ও জাহিদের সঙ্গে জালনোট ছাপানোর কাজে সহযোগিতা করতেন। তৈরি করা জাল টাকা প্রিন্টিংয়ের পর সঠিক সাইজ অনুযায়ী কাটিং এর কাজ করতেন। পাশাপাশি ফোনে এবং অনলাইনে অর্ডার করা জাল টাকা বিভিন্ন জনের কাছে পৌঁছে দিতেন তিনি।