এমরান আহমদ চৌধুরী সিলেট বিএনপির প্রিয়মুখ। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। আজকের এই অবস্থানে আসতে মায়ের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। মায়ের একান্ত অনুগত সন্তান তিনি। জীবনের প্রতিটি ধাপে আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন মা। পৃথীবি ছেড়ে চলে গেছেন মা। কিন্তু সেই মায়ের রেখে যাওয়া প্রতিটি আদেশ উপদেশ আজো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন এমরান চৌধুরী।
মায়ের মমতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এমরান চৌধুরী বলেন, মায়ের বিকল্প কিছু হতে পারে না। জন্মের পর থেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন মা। আদর, সোহাগের কমতি ছিল না। কিন্তু সুশৃঙ্খল জীবনের জন্যে শাসনেরও কমতি ছিল না। আমার মঙ্গলের জন্যে সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকতেন মা। জায়নামাজে বসে দুই হাত তুলে দোয়া করতেন মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে। সেই মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন রাজনীতি করতে গিয়ে। ১৯৯৬ সালের কথা। মা হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়। কিন্তু দেখার কোনো সুযোগ নেই। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক মামলায় ফেরারি জীবন কাটাচ্ছিলেন। হাসপাতাল ঘিরে পুলিশের অবস্থান ছিল প্রায় সার্বক্ষণিক। ফলে অসুস্থ মায়ের শয্যাপাশে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। মৃত্যুর পর মায়ের মুখ দেখার জন্যে অনেক কৌশল। কিন্তু পুলিশের আনাগোনা ব্যর্থ হতে হয়। অনেক কৌশল করে শেষ পর্যন্ত জানাজার নামাজ পড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই বেদনা আজো কষ্ট দেয়।
মায়ের সংসার জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে গোলাপগঞ্জের কোতোয়াল পুর (আয়াতাবাদ) গ্রামের এই কৃতি সন্তান এমরান আহমদ চৌধুরী বলেন, বাবা জিয়াউর রহমান চৌধুরী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মা আফিয়া খাতুন চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৬ সালে। তিন ভাই আর এক বোনের সংসার তাদের। ২ ভাই ও একমাত্র বোনও বেঁচে নেই। একমাত্র এমরান আহমদ চৌধুরী বেঁচে আছেন। বয়স যখন ৩-৪ বছর, তখন আরবি শিক্ষা দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয়। শিক্ষক ছিলেন মা। সন্ধ্যার পর মায়ের মুখ থেকে শিখেছি সুরা। সকাল হতেই মা ডেকে তুলতেন। বাড়ির পাশর্^বর্তী মসজিদের মক্তবে পাঠিয়ে দিতেন আরবি পড়ার জন্যে। মক্তব থেকে বাসায় ফেরার পরপরই স্কুলে পাঠানোর তোরজোর শুরু করতেন। সকালের খাবার খাইয়ে পাঠিয়ে দিতেন হেলি মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন এমরান চৌধুরী। এই স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন আতহারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুল থেকে ১৯৮৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় স্টার মার্ক পেয়ে প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। কলেজ জীবন শুরু করেন সিলেটের এমসি কলেজে।
এমরান আহমদ চৌধুরী জানান, শৈশব থেকে মায়ের সংসার দেখেছি। ভোরবেলায় পরিবারের সকলের আগে জেগে উঠতেন। নামাজ শেষে পরিবারের অন্য সদস্যদের জাগিয়ে তুলতেন। যাদের নামাজ পড়ার বয়স হয়েছিল তাদেরকে নামাজ পড়তে তাগাদা দিতেন। মায়ের ওই তাগাদার কারণে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয়েছে মসজিদে গিয়ে। মসজিদের অবস্থান ছিলো বাড়ির কাছে।
তিনি বলেন, আমরা ভাই বোনেরা স্কুলে যাওয়ার সময় বিভিন্ন উপদেশ দিতেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল কারো সাথে লাগালাগি করা যাবে না। লেখাপড়া করে বড় হতে হবে। আর লেখাপড়া করলে ভালো মানুষ হওয়া যাবে। মায়ের উপদেশ আর আদেশ পালন করতে সতর্ক থাকতাম। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে দেখতাম অপেক্ষা করছেন মা। দুপুরের খাবার শেষে বিশ্রামে যেতাম। বিকাল হতেই মায়ের কাছ থেকে অনুমোতি নিয়ে খেলার মাঠে ছুটে যেতাম। মায়ের আদেশ থাকত সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। মায়ের আদেশ লঙ্ঘন করতাম না। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতাম। ওজু করে মসজিদে যেতাম নামাজ পড়তে। সন্ধ্যার পর আগে কতক্ষণ আরবি পড়তাম। পরে বাংলা পড়তাম। রাতের খাবার শেষে সবাই যার যার ঘরে যেতেন। কিন্তু আমি যেতাম মায়ের ঘরে। মা সংসারের সব কাজ শেষে ঘুমোতে যেতেন। আগে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতেন আমাকে।
এমরান আহমদ চৌধুরী জানান, ১৯৮৪ সালে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হন। সেসময় এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়। এই সুযোগে কলেজ ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন তিনি। ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সর্ম্পৃক্ত হওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একবার গোলাগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণে গিয়েছিলেন। বাবার হাত ধরে শিশু এমরান চৌধুরী গিয়েছিলেন শহীদ জিয়ার অনুষ্ঠানস্থলে। খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন শহীদ জিয়াকে। তখন থেকেই তিনি মুগ্ধ হয়ে পড়েন শহীদ জিয়ার প্রতি। এছাড়া এমরান চৌধুরীর পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। বিশেষ করে শহীদ জিয়ার আদর্শকে লালন করতে তিনি ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক মাঠ ছিল উত্তাল। ওই উত্তাল মাঠের কর্মী হিসেবে এমরান আহমদ মিছিল মিটিংয়ে নিজকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৮৮ সালে এমসি কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহŸায়কের দায়িত্ব লাভ করেন এমরান আহমদ। ১৯৯০ সালে জেলা ছাত্রদলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হন।
২০০১ সালে জেলা ছাত্রদলের আহŸায়ক করা হয় এমরানকে। ২০০২ সালে সম্মেলনে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসভাপতির দায়িত্ব লাভ করেন এমরান আহমদ। ২০১৪ সালে সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহŸায়কের দায়িত্ব লাভ করেন তিনি। ২০১৬ সালে জেলা বিএনপির সম্মেলনে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৯ সালে জেলা বিএনপির আহŸায়ক কমিটির সদস্য করা হয় তাঁকে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। এর আগেই তিনি আইন পেশায় নিজকে সম্পৃক্ত করেন।
এমরান চৌধুরী জানান, এদেশের মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে অনেক। এরশাদ জমানায় মামলা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলার সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকে। মায়ের মৃত্যুর ১৫দিনের মাথায় পুলিশ গ্রেফতার করে এমরান চৌধুরীকে। এর পর একাধিকবার কারাগারে যেতে হয়েছে। গত ১৬ বছরে এমরান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৫৫ টি। এর আগে আরো ৩০টি মামলার আসামি হতে হয়েছে।
এমরান চৌধুরী বলেন, মা ছিলেন মূল শিক্ষক। প্রতিটা বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করতেন। এমসি কলেজে অধ্যায়নের সময় শহরে কোনো গোলমাল হলে মা ছুটে আসতেন। যে মেসে থাকতাম সেখানে গিয়ে খোজখবর নিয়ে আবার ফিরে যেতেন বাড়িতে। যাওয়ার সময় বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যেতেন। মোট কথা যখনই কোনো ক্রাইসেস দেখা দিত, তখনই পাশে পেতাম মাকে। আজো যখন কোনো ক্রইসেস দেখা দেয়, তখন মনে হয় ছায়া হয়ে মা পাশে দাঁড়িয়েছেন।