দীর্ঘ চার মাস ১২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য আহরণ শুরু হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরেই মৎস্য উন্নয়ন কেন্দ্রের আওতাধীন বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ৪১১৫ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয়েছে, যা থেকে সরকার প্রায় ৮ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা রাজস্ব আয় করেছে। ফলে গত বছরের তুলনায় এই বছর একই সময়ে (২ মাসে) রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৮.৯৭ শতাংশ। কাপ্তাই হ্রদে জেলেদের জালে বেশি ধরা পড়ছে কাচকি, চাপিলা ও আইর মাছ। বেশি রাজস্ব ও আসছে এসব মাছ থেকে।
নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর থেকে কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য আহরণ বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা বছরের বাকি সময়েও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কাপ্তাই মৎস্য উন্নয়ন উপকেন্দ্রের প্রধান কর্মকর্তার তথ্যমতে, এ বছর কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮,০০০ মেট্রিক টন এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। এখন পর্যন্ত দুই মাসেই লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক মৎস্য আহরণ এবং রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর একই সময়ে মাছের অবতরণ হয়েছিল ৩৯০০ মেট্রিক টন এবং রাজস্ব আয় হয়েছিল ৭ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা, যা তুলনামূলকভাবে এই বছরের চেয়ে কম।
এবার পানির স্তর কিছুটা বেশী থাকায় এবং মাছের প্রজনন সফল হওয়ায় জেলেরা অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছ আহরণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। তবে কিছু এলাকায় মাছের আকার ছোট থাকলেও জেলেরা কাপ্তাই হ্রদ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঁচকি, চাপিলা, এবং অন্যান্য প্রজাতির মাছ পাচ্ছেন।
কাপ্তাই হ্রদ বৃহত্তর মৎস্য ব্যবসায়ি সাধারণ সম্পাদক মোঃ শুক্কুর বলেন, এবছর পানি বেশি হওয়াতে হ্রদে মাছও ভাল হবে। এক সময় নদী গভীর ছিল বর্তমানে নদীর গভীরতা কমে গেছে তাই কার্পজাতীয় মাছ বড় হতে পারছে না। নদী খনন করা এখন সময়ের দাবী। নদী গভীরতা হলে কার্পজাতীয় মাছ বৃদ্ধি পাবে। হ্রদ দূষণ এর কারণ হচ্ছে পর্যটক ও নৌ যানগুলো সব ধরনের ময়না আবর্জনা হ্রদে ফেলে তাই হ্রদের পানি দিন দিন দূর্ষিত হচ্ছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে সকল ময়লা গিয়ে নদীতে গিয়ে পড়ে। রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের মাছ দেশ পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে রপ্তানি হয়। তাই এই হ্রদকে বাঁচানোর দায়িত্ব সবার।
মাহফুজুল হক বলেন, কাপ্তাই হ্রদের ছোট মাছের চাহিদা ঢাকাসহ সারা দেশে এবং বিদেশেও রয়েছে। চাপিলা, কাজুলি, কাচকি, টেংরা ও আইর মাছ ঢাকার বাজারে নিয়মিত সরবরাহ করা হয়। যদিও কিছু প্রজাতির মাছের উৎপাদন কমেছে, তবে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা ভালো চলছে। আশা করা যায়, সামনে আবারও মাছের সরবরাহ ও চাহিদা বাড়বে।
বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, কাপ্তাই হ্রদের মাছের চাহিদা দেশের প্রতিটি জেলায় রয়েছে এবং বিদেশেও রপ্তানি হয়। বিশেষ করে চাপিলা ও কাচকি মাছের চাহিদা বেশি। এখানকার মিঠা পানির মাছ গুণগত মানে ভালো হওয়ায় তা দেশের বাইরে রপ্তানি করা হয়, যা আমাদের স্থানীয় অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
বিএফডিসির ব্যবস্থাপক কমান্ডার মোঃ আশরাফুল আলম ভুঁইয়া জানান, ২০২৩-২৪ অবতরণ মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদে চাপিলা, কাচঁকি, কাজুলি, শোল, কইবোয়ালসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অবতরণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তবে রুই, কাতলা, মৃগেলসহ কিছু প্রজাতির মাছের উৎপাদন কমেছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে হ্যাচারি ও নার্সারি সম্প্রসারণ এবং অভয়াশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মৎস্য সম্পদ সুরক্ষায় রাঙামাটি জেলা প্রশাসন ও বিএফডিসি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অবৈধ জাল নির্মূল করছে। লেকের নাব্যতা রক্ষায় প্রতিবন্ধকতা ও বাঁধ নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবং সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হচ্ছে।
বিএফডিসি সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৫-৬৬ অর্থ বছরে মাত্র ১২০৬.৬৩ মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদনের মাধ্যমে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদের বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১-২২ সালে ৬ হাজার ১৫৪ মেট্রিক টন মাছ আহরণের বিপরীতে রাজস্ব আয় হয়েছে ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পরের বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাঙামাটির অধীনে কাপ্তাইসহ ৬টি অবতরণ কেন্দ্রে মোট ৭ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যায়, এতে অবতরণ করা মাছ থেকে মোট শুল্ক আদায় হয়েছে ১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এভাবে পালাক্রমে বেড়েই চলছে মৎস্য আহরণ ও রাজস্ব আয়ের রেকর্ড, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় কাপ্তাই হ্রদে সর্বোচ্চ আয়।
প্রসঙ্গত, হ্রদে কার্প জাতীয় মাছের বংশবৃদ্ধি, হ্রদে অবমুক্ত করা পোনা মাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধি, মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিতকরণসহ হ্রদের প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতি বছর ১মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়। তবে এবার হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়।
বায়ান্ন/এসএ