চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এবার সামাজিক উদ্যোগের তাগিদ দিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। তিনি বলেন, কিশোর অপরাধীদের অভ্যাসগত অপরাধী না ভেবে তাদের সমাজের মূল স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
বুধবার সকাল ১১টার দিকে দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের শুটিং ক্লাবে দিনব্যাপী আয়োজিত ‘ছিন্নমূল শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার’ বিষয়ক সেমিনারে সিএমপি কমিশনার এ বিষয়ে সকলকে কাজ করার আহ্বান জানান।
সিএমপি কমিশনারের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও অংশ নেন চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক নাজিবুল ইসলাম, ইউনিসেফ চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান মাধুরী ব্যানার্জী, সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সকল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগন।
ইউনিসেফ চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান মাধুরী ব্যানার্জী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় শিশু-কিশোরদের তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
তিনি অভিভাবকদের এ ধরণের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। অন্যথায় ছিন্নমূল শিশু কিশোররা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
অন্যান্য বক্তারাও ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন ও কিশোর অপরাধ দমনে তাদের মূল্যবান মতামত দেন। যা ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের অপরাধ প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
এদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ১৬টি থানা এলাকার কিশোর অপরাধিদের তালিকা থাকলেও তা রয়ে গেছে অনেকটা ফাইলবন্দি হয়ে। এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে গ্যাং লিডাররা। চলতি বছরের ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতনের পর নগরজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র জানায়, মূলত কিশোর অপরাধিরাই চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ড করে নগরবাসীকে বিষিয়ে তুলেছে। নগরে বস্তিকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা সবচাইতে বেশী বলে অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন এলাকার ভূক্তভোগী বাসিন্দারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বায়েজিদ এলাকার এক বাসিন্দা জানান, যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে তালিকা তৈরির প্রয়োজন কি। ওই এলাকায় কয়েক মাস আগে আধিপত্য বিস্তারের জেরে কিশোর গ্যাংয়ের দুগ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছে বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে জামিনে বেরিয়ে আসছে অনেক সন্ত্রাসী ও গ্যাং লিডাররা। এসব অপরাধী ও সন্ত্রাসীরা কেউ-কেউ আবারো পূর্বের কর্মে ফিরে আসলেও অনেকে আত্নগোপনে থেকে চালিয়ে যাচ্ছে নিরব চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে এমন আশঙ্কা রাজনৈতিক সচেতন মহলের।
জানা যায়, ২০০৫ সালে সিএমপির ১৬টি থানা এলাকার কিশোর অপরাধিদের তালিকা তৈরী করা হয়। সিএমপির প্রণীত ওই সন্ত্রাসী তালিকায় ৩৯৫ জনের নাম অর্ন্তভূক্ত করা হয়। এর তিন বছর পর ২০০৮ সালে আবারো সন্ত্রাসীদের তালিকা করেছিল সিএমপি। ওই সময়ে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র্যাব) সন্ত্রাসীদের পৃথক আরও একটি তালিকা তৈরী করে। র্যাবের ওই তালিকায় ১৬৩ জন সন্ত্রাসীর নাম ছিল। এরপর সর্বশেষ দীর্ঘ ১৩ বছর পর ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে নতুন করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ১৬টি থানা এলাকার সন্ত্রাসীদের তালিকা আবারো হালনাগাদ করা হয়। তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৩২৩ জন সন্ত্রাসী রয়েছে।
সিএমপির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, মূলত বড় ধরণের অপরাধি অথ্যাৎ ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িতদেরই এই তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। সেই সন্ত্রাসী তালিকাও অনেকটা ফাইলবন্দি।
এরমধ্যে নতুন করে যুক্ত হওয়া কিশোর গ্যাংয়ের তালিকার অবস্থাও একই। তবে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, সন্ত্রাসী তালিকা, কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা ধরে পুলিশ কাজ করছে। সামনে অভিযান আরো জোড়ালো করা হবে।
সূত্র মতে, সিএমপির ১৬টি থানা এলাকার কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদসহ থানা পুলিশের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত থাকলেও বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসী ও কিশোরদের গ্যাং লিডাররা।
সিএমপি প্রণীত এসব তালিকা নিয়েও রয়েছে নানা গুঞ্জন। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক তদবীরসহ নানা কারণে ওই সকল তালিকা থেকে বাদ পড়েছে অনেকে।
একাধিক সূত্র জানায়, জামিনে থাকা বিভিন্ন মামলার আসামীরা নতুন করে সন্ত্রাসী তালিকায় অর্ন্তভূক্ত না হওয়ায় তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে দিব্যি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে নের্তৃত্ব দিচ্ছে। চালাচ্ছে নিরব চাঁদাবাজিও। এছাড়া অধিকাংশ কিশোর গ্যাং লিডার এখনো অধরা। অপকর্মে জড়িত কিশোর গ্যাং লিডারদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ বিভিন্ন সময় অভিযান চালালেও সফল হচ্ছে খুব কম ক্ষেত্রেই।
সূত্র মতে, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, গার্মেন্টস ব্যবসা, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কিংবা আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে গ্রুপিং, সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং লিডাররা। পুলিশের কাছে কিশোর গ্যাং লিডার ও সন্ত্রাসীদের তালিকা থাকলেও অধিকাংশই অদৃশ্য কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, নগরীর ক্রাইমজোন হিসেবেখ্যাত অপরাধ প্রবণ এলাকার শীর্ষে রয়েছে, বায়েজিদ, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, কর্ণফুলী ও কোতোয়ালী থানা এলাকা। এসব থানা এলাকার বস্তিকে ঘিরে ভয়ংকর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে, কয়েকজন। তাদের গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য কিশোর ও র্দুর্ধষ অপরাধী। এসব অপরাধিরা সড়কের পাশের দোকান, নির্মাণাধীন ভবন, গার্মেন্টস, আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্নখাত থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চালাচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এদের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী গ্রুপও রয়েছে বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৬টি থানা এলাকায় বিভিন্ন নামে গড়ে উঠা প্রায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং রয়েছে। যারা জড়িয়ে পড়েছে দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে। সেবন করছে ইয়াবা, ফেন্সিডিলসহ নানা মাদকদ্রব্য। আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রও। এদের ছত্রছায়ায় রয়েছে বিভিন্ন বড় ভাই নামক শীর্ষ গডফাদাররা।
জানতে চাওয়া হলে, সিএমপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসীদের অপকর্ম ছাড়াও কিশোর গ্যাং কালচার চট্টগ্রাম নগরীতে থাকবে না। যেসব কিশোর গ্যাং লিডারের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তারা সবাই পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। পাওয়া গেলেই গ্রেপ্তার করা হবে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ কিশোর গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণে পুলিশী অভিযান জোরদার রয়েছে উল্লেখ করে কিশোর অপরাধীদের অভ্যাসগত অপরাধী না ভেবে তাদের সমাজের মূল মূল স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্ত করতে পারলেই কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মন্তব্য করেন।
বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএ