নদ-নদী বেষ্টিত কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলাটি রাজিবপুর সদর, কোঁদালকাটি এবং মোহনগঞ্জ তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। রাজিবপুর সদর ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন ব্রহ্মপুত্র নদের ১১ বর্গকিলোমিটারের বিস্তৃর্ণ দ্বীপচর কোদালকাটি ইউনিয়ন।
এ ইউনিয়নের চার পাশে নদী থাকায় প্রতি বছরই ভাঙ্গনের কবলে পরে ইউনিয়নবাসী। এ ইউনিয়নের চারটি মৌজার মধ্যে একটি নদীতে বিলীন হয়েছে অনেক আগেই। বর্তমানে ভাঙ্গনের কবলে রয়েছে আরও দুটি মৌজা। যেটুকু বাকী আছে সেটুকুর ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী সমাধান চায় কোদালকাটি ইউনিয়নবাসী।
আগে গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরু ছিল কোদালকাটি ইউনিয়নের প্রতিটি ঘরে ঘরে। এখন এমনটা আর দেখা যায় না। দেখা যায় নদী তীরে মাথায় হাত দিয়ে অপলোক দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকা শতশত নদী ভাঙ্গা মানুষদের আত্মচিৎকার এর প্রতিচ্ছবি। প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্র ও সোনাভরি নদীর ভাঙ্গনের কবলে জমি-জমা, ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে এ উপজেলার হাজার পরিবার।
গত সপ্তাহের ভারী বৃষ্টিপাতের কারনে নদীতে পানি বাড়ায় এবছরও ভাঙ্গনের তীব্রতা শুরু হয়েছে ব্যাপক হারে। হুমকিতে রয়েছে কোদালকাটি ইউনিয়নের সবচেয়ে পুরাতন বিদ্যাপিঠ বদরপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোদালকাটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সাদাকাত হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়, কোদালকাটি বাজার, ইউনিয়ন পরিষদ, ইউনিয়ন ভূমি অফিসসহ প্রায় ২০টি সরকারী বেসরকারী স্থাপনা। বর্তমানে কোদালকাটি ইউনিয়নে ৭০ হাজার মানুষের বসবাস। প্রতি বছরই নদীর একতীর ভাঙ্গলে অন্য তীরে পারি জমাতে হয় তাদের। সাংসারিক জীবনে দারিদ্রতার নিম্নসীমায় চরম দুর্দিন তাদের। প্রতি বছর বাড়ী সরানোর কারনে শিক্ষাধিক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে। এ অঞ্চলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ঝড়ে পরে কৈশর বয়সেই। সাম্প্রতিক একটি জরিপে উঠে এসেছে রাজিবপুর উপজেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা। এমন দারিদ্রতার কারন হিসেবে অনেকেই নদী ভাঙ্গনকে দায়ী করেছেন।
কোদালকাটি ইউনিয়নের সার্বিক উন্নয়ন ও নদী ভাঙ্গন রোধ কল্পে গত ২১ মে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অব: কর্ণেল জাহিদ ফারুক এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন এমপি কোদালকাটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তাৎক্ষণিক সামান্য জিওব্যাগ বরাদ্দ দেন, যা কাজ চলমান রয়েছে। এতে সম্পূর্ণ নদী ভাঙ্গন রোধকরা সম্ভব নয়। তাই নদী ভাঙ্গন রোধের স্থায়ী সমাধান চান কোদালকাটি ইউনিয়নবাসী।
চরসাজাই সরকার পাড়া গ্রামের সাজিদুল ইসলাম বলেন, নদীর এই পাড় ভাঙ্গে ওই পাড়ে যাই, আবার ওই পাড় ভাঙ্গে এই পাড়ে বাড়ি করি। এইভাবে আমাদের প্রতিবছর বাড়ি সরানো লাগে। আমরা এ প্রর্যন্ত ৫ বার বাড়ি সরাইছি। আমরা নদী ভাঙ্গন থায়কা বাচবার চাই।
কোদালকাটি গ্রামের আছমা বেগম বলেন, আমরা ধনী-ছিলাম নদী ভাঙ্গার কারনে আমরা গবিব হইছি মানসে আমাগোরে কয় তোমরা গরিব উপজেলার মানুষ শুনে আমাগরে সরম করে। আমরা সরকারের কাছে ত্রাণ চাই না, আমরা নদী ভাঙ্গন রোধ চাই।
বদরপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শফিক জুয়েল বলেন, নদী ভাঙ্গার কারনেই আমাদের স্কুলটি এখন ভাঙ্গনের কবলে নদীর পানি এখন কমছে আবার পানি বৃদ্ধি পেলে সাথে সাথে ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, নদী ভাঙ্গার কারনেই মূলত আমাদের এলাকাটি দরিদ্র। প্রতিবছর নদী ভাঙ্গার কারনে নতুন বাড়ি করতে হয় প্রত্যেকের। বছর না ঘুরতেই আবারও ওই একই টেনশন মাথায় থাকে আমাদের। দরিদ্র অবস্থা থেকে উন্নত করতে হলে এই এলাকার নদী ভাঙ্গন রোধই একমাত্র পন্থা। তাই সরকারের প্রতি আমদের প্রাণের দাবী নদী ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী সমাধান করতে হবে।
কোদালকাটি ইউপি চেয়ারম্যান এবং রাজিবপুর উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ছক্কু বলেন, নদী ভাঙ্গনের ফলে আমার ইউনিয়নের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে, এক সময় যাদের ১০০ বিঘা জমি ছিল, তারাও আজ আশ্রয়হীন হয়েছে। শতশত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে, আবার কেউ রাস্তার ধারে বাড়ি নিয়ে বসবাস করছে। প্রায় সকলেই দরিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উপনিত হচ্ছি, কিন্তু সেই ক্ষেত্রে কোদালকাটি ইউনিয়নের মানুষের দিনদিন দরিদ্র হচ্ছে। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আমার ইউনিয়নের মত ইউনিয়নকে নদী ভাঙ্গন থেকে রোধ করতে হবে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করতে হবে, তাহলেই আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারবো। তাই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আমার ইউনিয়নকে নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করলে ইউনিয়নবাসীর দুঃখ লাঘব হবে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদী শাসনের সমীক্ষা চলমান, কোদালকাটিকে এতে অন্তর্র্ভূক্ত করা হবে। এছাড়া ভাঙ্গন রোধে তাৎক্ষনিক বরাদ্দের কাজ চলমান রয়েছে। স্থায়ী সমাধান সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।##