সোনালি আঁশের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু পাটের সুদিন এখন আর নেই। গেল কয়েক বছর থেকেই পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার পাট চাষিরা।
চলতি বছর অনাবৃষ্টির কারণে পাটের ফলন যেমন কম হয়েছে, তেমন বেড়েছে খরচও। এছাড়া, শুরুতেই পাট জাগ দেয়া নিয়েও বিপাকে পড়তে হয়েছে পাট চাষিদের। তবে বর্তমান বাজারে পাটের দাম না থাকায় শঙ্কার মধ্যে দিন পার করছেন পাট চাষিরা। চাষের খরচ তোলা নিয়েও চিন্তায় রয়েছেন তারা। দাম কমে যাওয়ার জন্য চাষিরা সিন্ডিকেটকে দুষছেন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের কাছে এখনও গত বছরের পাট রয়েছে। এ জন্য পাট ক্রয় করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কম।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানাযায় , পাট চাষের সময় এবছর নানা বিড়ম্বনার শিকার হন চাষিরা। প্রথমত, বীজ বপনের সময় খড়া হওয়ায় ঠিকমতো চারা গজায়নি। আবার চারা গজালেও পাতলা হয়েছে। এতে করে ব্যাহত হয়েছে পাটের ফলন। এছাড়া, শ্রমিকের বাড়তি মজুরি, সেচ, বীজ, কীটনাশক, সারের দাম বৃদ্ধিতে বেড়েছে উৎপাদন খরচও। অন্যদিকে পাট কাটার সময় পানির অভাবে অনেক কৃষককে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সঠিক সময় পাট জাগ দিতে না পারায় নষ্ট হয়েছে পাটের রং।
রৌমারী উপজেলার রৌমারী’র পাটহাটে গিয়ে দেখা যায়, এই হাটে ভোর থেকেই প্রান্তিক চাষিরা তাদের উৎপাদিত পাট ভ্যানগাড়ি, সাইকেলসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে হাটে। এরপর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চলছে তাদের দর কষাকষি। গড়ে প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। তবে বাজারে যে দামে পাট বেচাকেনা হচ্ছে তাতে কোনো কোনো চাষিকে পাট বিক্রি করে বিষণ্ন মনে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে।
পাট বিক্রি করতে আসা উপজেলার ফলুয়রচর গ্রামের পাটচাষি আজিজুল হক বলেন, ‘এ বছর আমি ৪ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। খড়ার কারণে আমার ২ বিঘা জমিরপাট মরে গেছে। পরে অন্যের শেলোমেশিন দিয়ে সেচ দিয়ে দুই বিঘা জমির পাটরক্ষা করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এবার পাট চাষে অনেক খরচ হয়েছে। কিন্তু সেই হিসাবে বাজারে পাটের দাম পাচ্ছি না। দুই বিঘা জমি থেকে ১৫ মণ পাট পেয়েছি। আজকে এই হাটে পাট প্রতি মণ হিসাবে ২ হাজার ৩০০ টাকা বিক্রি করলাম। আপনারাই বলেন, ৪ বিঘা জমিতে পাট চাষ করে কত টাকা লাভ হয়েছে?’
উপজেলার চরশৌলমারী গ্রামের পাটচাষি জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘চলতি বছর আমি এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে ৭ মণ পেয়েছি। খড়ার কারণে প্রথমেই পাটের গাছ মরে গেছে। পাটের চারা শেলোমেশিন দিয়ে সেচ দিয়ে কোনো রকম রক্ষা করা হয়েছে। এক বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। পাট পেয়েছি ৭ মণ। আজকে এই হাটে প্রতি মণ ২ হাজার ১০০ টাকা হিসাবে পাট বিক্রি করলাম। আমার ৭ মণ পাট বিক্রি করে টাকা হয়েছে ১৪ হাজার ৭০০ টাকা। এতে করে আমাদের কয় (কত) টাকা লাভ হবে বলেন।’
রাজিবপুর উপজেলা থেকে পাট বিক্রি করতে আসেন আবুল হোসেন বলেন, ‘আমি এ বছর দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। প্রতি বিঘায় ৭ মণ করে পাট পেয়েছি। অনাবৃষ্টির কারণে ফলন কম হয়েছে। এছাড়া, পানির অভাবে সঠিক সময় পাট জাগ দিতে না পারায় কালার নষ্ট হয়ে গেছে। একে তো কালার নষ্ট হয়ে গেছে এর মধ্যে আবার বাজারে পাটের দাম খুবই কম। রৌমারীর ব্যবসায়ীরা অন্য জেলার পাট ব্যবসায়ীদের এলাকায় আসতে বাধা সৃষ্টি করে। এতে করে ব্যবসায়ীরা বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করে কম দামে পাট কেনে। আমরা কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাই না।’
ইজলামারী গ্রামের জায়দুল ইসলাম নামে এক পাট ব্যবসায়ী বলেন, ‘১৫-২০ বছর থেকে পাটের ব্যবসা করি। এখান থেকে পাট কিনে জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকি। মোকামে বেচাকেনা না থাকায় পাটের দাম কমে গেছে। আগামীতে দাম বাড়বে কিনা, বলা যাচ্ছে না।’
নুর ই আলম নামের ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত বছরের ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫’শ টাকা পর্যন্ত প্রতিমণ হিসাবে অনেক পাট কেনা আছে। সেই পাটই বিক্রি করতে পারি নাই। মিলারদের পাট দিলে তারা টাকা দিতে চায় না। আমাদের মতো ব্যসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরাও চাই সরকার বাজার তদারকি করুক।’
রৌমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল পাটের আবাদ হয়েছে। গত বছর পাট চাষের লক্ষমাত্রা ছিল ২ হাজার ১৭৭ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এবার ১২৩ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ বেশি হয়েছে। তবে পাটের বীজ বপনের সময় বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে কৃষকরা সঠিক সময়ে জমিতে পাটের বীজ বপন করতে পারেনি। এছাড়া, পাট কাটার সময় পানির অভাবে জাগ দেয়ার যে সমস্যা, সেই কারণে কৃষকরা পাট চাষ করতে আগ্রহ হারাচ্ছে। তবে পাটের ফলনে কোনো বিপর্যয় ঘটেনি।’