ঢাকা, রবিবার ৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২২শে পৌষ ১৪৩১

শীতকালীন ডায়রিয়া: প্রতিদিন ৬৭৫ শিশু ভর্তি হচ্ছে আইসিডিডিআরবিতে

ডেস্ক রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ৩ জানুয়ারী ২০২৫ ১১:০৩:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

শিশুদের মধ্যে শীতকালীন ডায়রিয়া বেড়ে গেছে। প্রতিদিন গড়ে ৬৭৫ শিশু ডায়রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবির) মহাখালীর হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এদের বড় অংশ রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।

আইসিডিডিআরবির চিকিৎসক ও গবেষকেরা বলছেন, রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। অনেক শিশুকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। বাড়িতে ভুলভাবে স্যালাইন খাওয়ানোর কারণে অনেক শিশু রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম নিয়ে বা ‘হাইপারনেট্রিমিয়া’র  লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসছে। নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ১৫টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে আইসিডিডিআরবি সূত্র জানিয়েছে। 

বছরের অন্যান্য সময় যে ডায়রিয়া বা কলেরা দেখা দেয়, তার থেকে শীতকালীন ডায়রিয়ার কিছুটা পার্থক্য আছে। শীতকালে শিশুদের ডায়রিয়ার মূল জীবাণু রোটাভাইরাস। আইসিডিডিআরবির নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের হাসপাতাল শাখার সহকারী বিজ্ঞানী শোহেব বিন ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে প্রচুর শিশু আসছে রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়া নিয়ে। গত বছরের চেয়ে রোগী প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। কিছু শিশু বেশ খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে আসছে।’

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আইসিডিডিআরবির মহাখালীর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, রাজধানীর আশপাশ এলাকা এবং অন্যান্য জেলার শিশুরাও ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রত্যেক শিশুর সঙ্গে আছেন তার মা। কারও শয্যার পাশে মায়ের সঙ্গে বাবা বা অন্য আত্মীয় আছেন। গাজীপুরের মহিমা আক্তার গতকাল সকালে তাঁর এক বছরের মেয়ে উমাইয়া বিনতে মুস্তাকিমকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন।

মহিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গত মঙ্গলবার থেকে তাঁর মেয়ের জ্বর, বমি ও ডায়রিয়া দেখা দেয়। স্থানীয় একজন চিকিৎসক স্যালাইন, প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিবায়োটিকের পরামর্শ নেন। তাতে কাজ হয়নি। শিশুটি দুর্বল হতে থাকে। ঝুঁকি না নিয়ে তিনি হাসপাতালে এসেছেন।

কত শিশু, কোথা থেকে আসছে

বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ডায়রিয়া নিয়ে ৮৫০ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আইসিডিডিআরবির দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, কোনো কোনো দিন নয় শর বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। ২৪ নভেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভর্তি হওয়া রোগী হিসাব করলে দেখা যায়, দৈনিক ৮৫০ জন ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু। এদের বয়স পাঁচ বছরের কম। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুই বছর বা তার কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৭৬ শতাংশের বেশি।

আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন ধরনের ডায়রিয়া নিয়ে শিশুরা হাসপাতালে আসছে। এর মধ্যে রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু বেশি। এতে শিশুর ঘন ঘন পায়খানা হয়। পায়খানার রং কিছুটা দুধের মতো সাদা।

ঢাকা শহরের ২৫টি এলাকা থেকে শিশুরা বেশি হাসপাতালে আসছে। শীর্ষে থাকা প্রথম পাঁচটি এলাকার মধ্যে আছে মোহাম্মদপুর, গুলশান, কামরাঙ্গীরচর, আশুলিয়া ও মিরপুর। ঢাকার আশপাশ এলাকার মধ্যে বেশি রোগী আসছে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও কেরানীগঞ্জ থেকে।

শিশুরা ঝুঁকিতে পড়ছে

ডায়রিয়া হলে বয়স্ক মানুষের মতো শিশুদেরও স্যালাইন খাওয়ানো হয়; কিন্তু নিয়ম বা বিধি মেনে স্যালাইন না খাওয়ানোর কারণে শিশুদের ঝুঁকি বাড়ছে। আইসিডিডিআরবির আইসিইউতে ভর্তি আছে নরসিংদীর মাধবদী থেকে আসা এক বছর বয়সী ইভা। শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইভার মা আয়শা আক্তার বলেন, শনিবার ডায়রিয়া শুরু হলে ইভাকে স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করেন। কম পানিতে গোলানো গাঢ় স্যালাইন। পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যায়নি; বরং খিচুনি দেখা দেয়। সোমবার ইভাকে আইসিডিডিআরবিতে আনা হয়। পরিস্থিতি দেখে শিশুটিকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।

আইসিইউর দায়িত্ব থাকা চিকিৎসকেরা বলেন, শিশুটি ‘হাইপারনেট্রিমিয়া’র লক্ষণ ছিল। অর্থাৎ শিশুর রক্তে প্রয়োজনের চেয়ে সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি ছিল। প্রয়োজনের চেয়ে সোডিয়াম বেশি থাকলে শিশুর খিচুনি হয়, কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শিশু মারাও যায়। সঠিক চিকিৎসা না হলে স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি হয়। যেসব শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তাদের ডায়রিয়ার পাশাপাশি অন্য রোগও ছিল বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।

আইসিডিডিআরবির ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সার্ভিসেস বিভাগের বিজ্ঞানী লুবাবা শাহরিন প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে লক্ষণ বিবেচনায় ৬২৬টি শিশুর ইলেকট্রোলাইটিস পরীক্ষা করা হয়। তাতে ৯১ শিশুর ‘হাইপারনেট্রিমিয়া’ শনাক্ত হয়েছে।

ওআরএস নিয়ে ধারণা কম

ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টস বা ওআরএস একটি ওষুধ। পানিতে গুলিয়ে স্যালাইন তৈরি ও খাওয়ার নিয়ম প্রতিটি প্যাকেটে লেখা আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিকভাবে স্যালাইন তৈরি করতে ও শিশুকে খাওয়াতে জানেন না মায়েদের একটি অংশ।

আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি এমন ৩৫০ শিশুর মায়ের ওপর গবেষণা করেছেন নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী শারিকা নুজহাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৮৮ শতাংশ মায়ের ওআরএস সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। কীভাবে শিশুকে স্যালাইন খাওয়াতে হয় তা জানেন না ৭২ শতাংশ মা। ২৪ শতাংশ মায়ের ধারণা স্যালাইনের চেয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ডায়রিয়া চিকিৎসায় বেশি কার্যকর।

গবেষকেরা বলছেন, কম পানি দিয়ে স্যালাইন তৈরি করেন মায়েরা, অল্প সময়ে বেশি পরিমাণে স্যালাইন শিশুদের খাওয়ানো হয় এবং তৈরি করা স্যালাইন অনেক পরে শিশুকে খাওয়ানো হয়। এগুলো ‘হাইপারনেট্রিমিয়া’র কারণ।

করণীয়

শিশুদের মধ্যে রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়া গত বছর নভেম্বর থেকে বাড়তে দেখা গেছে। এই পরিস্থিতি আরও মাসখানেক থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শিশুস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বলছে, রোটাভাইরাসের টিকা আছে। ভারত ও আফগানিস্তানে রোটাভাইরাসের টিকা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। বিশিষ্ট শিশুরোগবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) রোটাভাইরাসের টিকা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।’

আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ওআরএসের ব্যাপারে মায়েদের ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। লুবাবা শাহরিন বলেন, শিশুকে ঘরের বাইরের খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশুদ্ধ খাবার পানি খাওয়াতে হবে। শিশুকে খাওয়ানোর আগে হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে। শিশুর মল পরিষ্কার করার পরও হাত ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। সূত্র: প্রথম আলো

 

বায়ান্ন/এসএ