ঢাকা, শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

কুষ্টিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে একেরপর এক খুন ধংশস্তুপে পরিনত কমলাপুর পাহাড়পুর গ্রাম

কুষ্টিয়া প্রতিনিধিঃ | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ২৭ জানুয়ারী ২০২২ ০৪:২৯:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর
এর পরে কে খুন হবে? এমন প্রশ্ন এখন পাহাড়পুর, কমলাপুর গ্রামে অনেকের মুখে। খুন, হামলা, মামলা এড়াতে পাহাড়পুর, কমলাপুর গ্রাম এখন প্রায় পুরুষ শুন্য। কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলা চাপড়া ইউনিয়নের কমলাপুর ও পাহাড়পুর গ্রাম দুটি আতংকপুর হিসেবে রুপ নিয়েছে।

গত চার বছরে চার(৪) টি খুন ও আনুমানিক ৪০০ মানুষ আহত হয়েছেন কমলাপুর গ্রামে। শত-শত ঘরবাড়ি, মাঠের সফল,গাছপালা বিনষ্ট করেছে প্রতিপক্ষ। বসতভিটে ছেড়ে পালিয়েছে কয়েক শত মানুষ। আমিরুল খুন হওয়ার পর এ সংখ্যা বর্তমানে কয়েক গুন বেড়েছে।

কমলাপুর ও পাহাড়পুর গ্রামে  শেখ - মন্ডল ও ব্যাপাড়ি এই তিন সমাজের মানুষ বসবাস করতো। শুরুতে সবার মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরন ছিলো। তবে দিন গড়ানোর সাথে সাথে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে সবার সাথে সবার সম্পর্কের ফাঁটল ধরতে শুরু করে। গ্রামের আধিপত্য নিতে মন্ডল ও শেখ জোট বাধে অন্যদিকে ব্যাপাড়ি তখন স্থানীয় কটা মেম্বারের সাথে জোট করে। এর পর থেকেই গ্রামে শুরু হয় অশান্তি। প্রতিনিয়ত দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি লেগেই থাকতো। ২০১৫ সালে দুই পক্ষের এমনই এক  সংঘর্ষ থেকে বাবাকে ফিরিয়ে আনতে গেলে জোতপাড়ার সবুজ নামে এক যুবক বল্লবের আঘাতে আহত হয়। পরে ঢাকাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। সেই থেকে মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে শেখ- মন্ডল ও ব্যাপাড়ি- কটা মেম্বর গ্রুপ। এর পর ২০১৭ আবার দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ (কাইজা) বাধলে ৯ম শ্রেনীর ছাত্রী রুমী ফালার আঘাতে নিহত হয়। এই হত্যা কান্ডের প্রতিশোধ নিয়ে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ আবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ব্যাপাড়ি- কটা মেম্বর সমাজের একই পরিবারের নেহেদ আলী ও বকুল আলীকে রাতের আধারে খুন করে, আহত হয় অর্ধশত মানুষ। জোড়া এই খুনের প্রতিশোধ নিয়ে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর জোড়া খুনের প্রধান আসামী নয়ন মন্ডলের ছেলে খোকন মন্ডলের উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় প্রতিপক্ষ। সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান খোকন, তবে তার হাতের কবজির ৯০% কেঁটে পড়ে যায়। বর্তমানে তিনি ঢাকা পঙ্গু হাসপালে চিকিৎসারত আছেন। খুনের বদলে খুন করতে না পেরে প্রতিপক্ষ আবার হামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এমন সময় জোড়া খুনের আরেক আসামী আমিরুল জামিনে বের হয়ে গ্রামে আসলে হামলা চালাই প্রতিপক্ষ। সেই হামলায় আমিরুল কে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। সংঘর্ষে আহত হয় অন্তত ১০ জন। প্রতিটি হত্যার পরে একপক্ষ লুটপাটের উৎসব করে গ্রামে। প্রতিপক্ষের গরু,ছাগল, গোলার ধান, মাঠের ফসল, গাছপালা এমনকি হাঁস মুরগি সহ সব কিছু নিয়ে চলে যায় লুটপাটকারীরা। এক পক্ষ হামলা, মামলার ভয়ে গ্রাম ছাড়লে প্রতিপক্ষ তাদের কাঁচা, পাঁকা বড়বাড়ি মাটির সাথে গুড়িয়ে দেয়। স্কুল গুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিত হাতে গোনা কয়েকজন।

সরোজমিনে গিয়ে গ্রামে গিয়ে দেখে মনে হচ্ছে হাজার বছর আগে কোন সমাজের ধংশ স্তুপ বা প্রত্নতাত্বিক বিভাগের মাটি খুড়ে উদ্ধার করা কোন বিহার অথবা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের বোমার আঘাতে ধংসস্তুপে পরিনত হওয়া একটি গ্রাম। গ্রামে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না কোন যুবক ও একটু কম বয়স্ক পুরুষকে। তারা সবাই আমিরুল খুনের পর থেকে হামলা,মামলার ভয়ে পালিয়েছে। জনশূন্য গ্রাম চারিদিকে শুধু বংশস্তুপ। ঘড়বাড়ি থেকে শুরু করে মাঠের ফসল পর্যন্ত ধংশস্তুপে পরিনত হয়েছে। যে কয়েকজন মানুষ গ্রামে আছে তারা বলেন, কয়েকটি মানুষ তাদের নিজস্ব স্বার্থের জন্য গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে রেখে তাদের স্বার্থ হাসিল করে আর ভুগতে হয় সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ গুলোকে। গ্রামের কোহিনুর বেগম বলেন, আমরা কোন দিন মারামারিতে যায়নি তবুও কিছু হলে মামলা দেয়, ঘরবাড়ি ভাংচুর, লুটপাট করে সব নিয়ে যায়। আরিফুল নামে এক যুবক কুষ্টিয়া শহর থেকে বলেন, আমি এ বছর এসএসসি পাস করেছি কলেজে ভর্তি হবো কিন্তু গ্রামে মারামারির জন্য বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। আমার পড়াশোনা নষ্ট হচ্ছে, গ্রামে যেতে পারছিনা। গ্রামবাসি মনে করেন, এ সংঘর্ষ বছরের পর বছর চলতে পারেনা। তারা স্থানীয় সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে কোন ভাবে গ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন।

এ বিষয়ে কুমারখালী-খোকসা থেকে নির্বাচিত ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ এমপি সাংবাদিকদের জানান, এটা কোন রাজনৈতিক সংঘর্ষ না। গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় মাতব্বরদের মধ্যে বংশীয় সংঘর্ষ। এখানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করা হচ্ছে। প্রশানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা শান্তি ফিরিয়ে আনতে আইনি পদক্ষেপ নিবেন।

আমিরুল হত্যার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ আকিব জানান, সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রকৃত আসামিদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। যারা খুনের সাথে জড়িত না তাদের মামলায় জড়ানো হবেনা। তাই নির্ভয়ে গ্রামে ফিরে আসার জন্য আহবান করেন।