ঢাকা, শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

‘আমার বাজানে মরে নাই, ওর মুখটা দেখতে দাও’

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ১ ফেব্রুয়ারী ২০২২ ০১:১৮:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে প্রচণ্ড শীতে সাত বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের বাড়ি মাদারীপুরে। মৃত্যুর খবর পেয়ে মাদারীপুরের সদর উপজেলার বড়াইল বাড়ি এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে চলছে স্বজনদের শোকের মাতম।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মারা যাওয়া জয় তালুকদারের (২৩) বাড়ি সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ি গ্রামে। জয়ের বাড়িতে গভীর নীরবতা। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে আহাজারি করছেন মা লক্ষ্মী তালুকদার। ছেলের মুখ দেখার জন্য সবার কাছে আকুতি জানাচ্ছেন।

তিনি বিলাপ করে বলছেন, ‘আমার বাজানে মরে নাই। ও কইছে, ইতালি গিয়া ফোন দিব। ওরে একবার ফোন দিতে কও। আমি বাজানের মুখটা একটু দেখতে চাই।’ জয়ের মায়ের কান্নায় চারপাশের প্রকৃতিও শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে।

সাগরপথে যাত্রা হওয়ার আগে ২২ জানুয়ারি সকালে জয়ের সঙ্গে তার মায়ের মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল। ছেলের সঙ্গে সবশেষ বলা কথা স্মরণ করে তিনি বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছেন।

তার বাবা পলাশ তালুকদার জয়ের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। এর আগেও মাদারীপুরের কমপক্ষে শতাধিক যুবক নিহত ও নিখোঁজ হয়। বাংলাদেশ দূতাবাস ২৫ জানুয়ারি বিষয়টি জানতে পারে।

২৯ জানুয়ারি নিহত সাতজনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করেছে ইতালি দূতাবাস। নিহতদের পরিবারকে নিকটস্থ জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রোম দূতাবাসে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

এদিকে সরেজমিন মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারপুর গ্রামে নিহত ইমরানের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, গত বছর অক্টোবর মাসে ধারদেনা করে দালাল সামাদের কাছে প্রথম কিস্তি চার লাখ টাকা দেয়। পরে আরও লিবিয়া পৌঁছানোর পর সাড়ে তিন লাখ টাকা দেয় দালালের কাছে। নিহত ইমরানের বাবা ভ্যানচালক। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সুদে এবং এনজিও থেকে ঋণ করে ছেলে ইউরোপের পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয় না। লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মারা যায় ইমরান।

ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ, মিসরসহ বিভিন্ন দেশের ২৮০ জনের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকায় করে লিবিয়ার উপকূল থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা করেন। যাত্রা শুরুর একদিন পরে ভূমধ্যসাগরে প্রচণ্ড ঝড় বাতাসের পর টানা বৃষ্টি হয়। নৌকাটি ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছায়। পরে ইতালিয়ান কোস্টগার্ডের সদস্যরা তাদের উদ্ধার করেন। এ সময় প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মারা যান সাতজন। এদের পাঁচজনের বাড়ি মাদারীপুরে।

নিহতরা হলেন— মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারপুর গ্রামের শাজাহান হাওলাদারের ছেলে ইমরান হোসেন, বড়াইবাড়ি গ্রামের প্রেমানন্দ তালুকদারের ছেলে রতন তালুকদার জয়, ঘটকচরের সাফায়েত, মোস্তফাপুরের জহিরুল ইসলাম এবং মাদারীপুর সদরের বাপ্পী। নিহতের খবরে এসব পরিবারে চলছে শোকের মাতম।

নিহত মাদারীপুরের জয়ের পরিবারের সদস্যরা বলেন, দালালের প্রলোভনে পড়ে গত ২৮ নভেম্বর পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইবাড়ি থেকে জয় তালুকদার ও তারই চাচাতো ভাই প্রদীপ তালুকদার (২১), মিঠু তালুকদার (২২), তন্ময় তালুকদারসহ (১৯) ছয় তরুণ ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশে মাদারীপুর ছাড়েন। তারা দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। পরে লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় প্রায় দেড় মাস বন্দি থাকেন। গত ২২ জানুয়ারি তাদের সাগরপথে যাত্রা শুরু হয়। গন্তব্য ইতালি। ওই রাতে এ সময় নৌকা থেকে সাত বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে মাদারীপুরের জয়ও ছিলেন।

জয়ের বাবা পলাশ তালুকদার পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জয় মেজ। দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। যে কাম-কাজ করি, তা দিয়া সংসার চলানো খুবই কষ্ট হয়। আমাগো এলাকার ছেলে জামাল। জামালই ইতালিতে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। পরে ওরে বিশ্বাস কইরা ধারদেনা আর জমি বেইচা সাত লাখ টাকা জোগাড় করি। প্রথমে দালালরে ৫০ হাজার দিছি। পরে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পরে সাড়ে ছয় লাখ দিছি। এতগুলা টাকা গেল, তবু যদি পোলাডা বাঁইচা থাকত, তা হলে দুঃখ থাকত না। আমাগো সব শ্যাষ হইয়া গেল। এহন আমি কী যে করমু, কিছুই বুঝতে পারতেছি না। আমার পোলার লাশটা যেন পাই। আর কোনো আবদার নাই।’

জয়ের চাচা গোবিন্দ তালুকদার বলেন, ‘আমার ছেলে প্রদীপ, ভাতিজা জয়সহ আমাগো বাড়ির চার ছেলে এই পথে ইতালিতে যায়। ওরা তিনজন কোনোমতে কষ্টে ইতালিতে পৌঁছলেও জয় পথেই মারা গেল। আমরা ছেলে প্রদীপ জয়ের মৃত্যুর সংবাদ আমাগো জানাইছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামাল খান বড়াইলবাড়ি এলাকার সোনা মিয়া খানের ছেলে। ইতালিতে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে জামাল সাত লাখ টাকা করে নেন। জয়ের মৃত্যুর খবরের পর থেকে তিনি এলাকায় নেই। দীর্ঘদিন ধরে জামাল মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদর থানায় মানব পাচার আইনে একটি মামলা রয়েছে। এ মামলায় তিনি দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। প্রায় এক বছর আগে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে বের হন। আবার শুরু করেন দালালি পেশা।

পেয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান লাভলু তালুকদার বলেন, আমার এলাকায় কিছু দালাল আছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও আছে। বিচার না হওয়ায় দালাল চক্র ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে কিছু টাকা আর ভয়ভীতি দেখিয়ে দালালরা মীমাংসা করে নেন। এ কারণে অবৈধপথে বিদেশযাত্রা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।

মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম মিঞা বলেন, ঠাণ্ডার কারণে ভূমধ্যসাগরে মৃত সাত বাংলাদেশির মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি মাদারীপুর সদরে। তার পরিবারকে থানায় দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে দালালের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হবে।

মাদারীপুরর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, দূতাবাস থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের পরিচয় শনাক্ত করনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে বলা হয়েছে। সে মোতাবেক আমরা নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিলে লাশ দেশে আনার সব ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করবে।