ঢাকা, সোমবার ৬ জানুয়ারী ২০২৫, ২৩শে পৌষ ১৪৩১

ঐতিহ্য ঠিক রাখতে ঝিনাইদহের খেজুর গুড়ে ফের আস্থা ফিরছে

সুলতান আল এনাম, ঝিনাইদহ | প্রকাশের সময় : শনিবার ৪ জানুয়ারী ২০২৫ ০১:১৯:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

ঐতিহ্যের কথা ভুলে ঝিনাইদহে ব্যাঙের ছাতার মতো শত শত কারখানায় অপরিশোধিত চিনি-গুড়ে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যহানিকর খেজুরগুড়। এই খেজুর গুড়ে নেই খেজুরের রস। এ গুড়ের উপাদান ঝোলা গুড়, অপরিশোধিত ভারতীয় চিনি-গুড়, রং, আটা, রাসায়নিক ও ভেষজ নির্যাস। 

যে কারণে প্রতি বছর খেজুর গাছের সংখ্যা কমলেও বাড়ছে গুড় উৎপাদন। জেলা সদর সহ ৬টি উপজেলার আনাচকানাচে গড়ে উঠেছে এসব ভেজাল গুড় তৈরির কারখানা। প্রতিদিন শত শত মণ গুড় ঝিনাইদহের আশপাশের জেলাসহ এসব গুড় যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে যেমন  ঝিনাইদহের ঐতিহ্যের সুনাম নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৮০ শতাংশ খেজুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কৃষি বিভাগের খেজুর গাছ রক্ষায় কোন ভুমিকা না থাকায়, খেজুর গাছের ক্ষেত উজাড় করা হয়েছে। 

একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদনের জন্য খেজুরের ক্ষেত নষ্ট করে অন্য আবাদের দিকে ঝুকছেন চাষিরা। অথচ ৯০ দশকের দিকেও শীত মৌসুমে এ শিল্পের কদর ছিল দেশ জুড়ে। ঝিনাইদহের গুড়-পাটালি মানেই শীত মৌসুমে অতিথিদের আগাম বায়না ধরা। সময় এলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা অতিথিদের  কুরিয়ার অথবা অন্যান্য যোগে পাঠানোর পালা পড়ে যায় ঝিনাইদহ বাসীর। এতে সারা দেশে ক্রমান্বয়ে সুনাম ছড়াতে থাকে ঝিনাইদহের খেজুর গুড়-পাটালীর।

বর্তমানে খুবই সীমিত সংখ্যক কৃষক খেজুর গুড় তৈরি করলেও ভেজাল ও কেমিকেল মিশ্রণের ফলে বদনাম হয়ে গেছে। যেকারণে ঝিনাইদহের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের প্রতি অনাগ্রহী হয়েছে সারাদেশের মানুষ। আগের মতো আর যেখানে-সেখানে খেজুর গুড়ের হাট বসে না। গত দুবছর ধরে জেলার কৃষি বিভাগ খেজুর গাছ ও ঐতিহ্যবাহী গুড়ের দিকে নজর দিয়েছে। কৃষকদের খেজুর গাছের চারা রোপণে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। 

প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঝিনাইদহ শহরতলীর নগরবাথান বাজারে রাসেল গ্লোবাল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে খেজুরের গুড় তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে সনাতন পদ্ধতিতে সম্পুর্ণ নির্ভেজাল ভাবে খেজুরের গুড় তৈরি করা হয় বলে দাবী করেছেন প্রতিষ্ঠানটি। ইতিমধ্যে তারা অফলাইন ও অনলাইনে গুড় এবং গুড়জাত পণ্য বিক্রি করা শুরু করেছেন। তাদের লক্ষ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি বিদেশেও গুড় ও গুড়জাত পণ্য রপ্তানি করা। রাসেল গ্লোবাল লিমিটেডের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়ে এলাকার প্রায় আড়াইশত চাষি নিরাপদ ও নির্ভেজাল গুড় তৈরি করছে। 

বর্তমানে তাদের নিজস্ব কারখানায় ১৬ জন শ্রমিকের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ কেজি গুড় তৈরি করা হচ্ছে। তাদের উৎপাদিত গুড়ের ৮০ ভাগ কারখানা থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। শীত বাড়লে তাদের উৎপাদন আরও বাড়বে বলে জানান উদ্যোক্তা রাসেল আহমেদ। রাসেল আহমেদ জানান, বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্য থাকায় গুড় তৈরিতে শতভাগ মান রক্ষার চেষ্টা করছেন। 

রসের হাড়ি বা ভাড় ধোয়া থেকে শুরু করে রস জ্বালিয়ে গুড় উৎপাদন পর্যন্ত সব কিছুতেই মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রাসেল আহমেদ ঝিনাইদহ সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজ থেকে বিএসএস সম্পন্ন করে ঢাকার মিরপুরে আপডেট আইটি লিমিটেড নামে একটি সফটওয়্যার ফার্ম খোলেন। ২০২০ সালে সারা বিশ্বে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ফার্মটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালে নিরাপদ কৃষি পণ্য উৎপাদন ও বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যে রাসেল গ্লোবাল লিমিটেড নামে এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন। বিভিন্ন ফল-ফলাদির সাথে কাজ শুরু করেন খেজুরের খাটি গুড় প্রস্তুত ও বাজারজাত করেন। 

তারা ইত:মধ্যে জেলার বিভিন্ন সড়কে ও পতিত জমিতে প্রায় ৩০ হাজার খেজুরের চারা রোপণ করেছেন। কৃষি অধিদপ্তর, বারটান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিকার অধিদপ্তরের সহযোগিতায় জেলার প্রায় ৪ শতাধিক কৃষককে খেজুরের নিরাপদ রস ও গুড় উৎপাদনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। রাসেলের এই উদ্যোগের সাথে যোগ হয়েছেন আরও ৬ তরুণ। 

কিন্তু কারখানার দেখাশুনা করেন রাসেল একাই। তাদের কারখানায় এখন প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ লিটার রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। প্রতি ৬ লিটার রস থেকে এক কেজি গুড় তৈরি হয় বলে জানান রাসেল। তিনি বলেন, আমরা বেশ কিছু কৃষকের কাছ থেকে খেজুর গাছ লিজ নিয়েছি এবং কিছু কৃষকের কাছে রসের ভাগাভাগি করে কন্ট্রাক্ট নিয়েছি। প্রতিদিন সকালে আমাদের নিজেদের গাড়ি দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। সেই রস কারখানায় নিয়ে এসে জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। কারখানায় প্রতিদিন ৬ জন নারীসহ ১৬ জন শ্রমিক গুড় প্রস্তুত করতে কাজ করেন। এসব তৈরি গুড়ে কোন কেমিকেল ব্যবহার করা হয় না। রস সংগ্রহের জন্য ভালোভাবে হাড়ি ধুয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। গাছ কেটে নেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে পাখি বা বাদুড় বসতে না পারে। 

সকালে ড্রামে করে রস সংগ্রহ করা হয়। একটি গাছ একদিন কাটার ৪-৫ দিন পরে আবার কাটার উপযোগি হয়। এর মধ্যেও রস হয় যেটাকে বলে ওলা রস কিন্তু সেই রস নেয়া হয় না। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিকেজি গুড় উৎপাদনে প্রায় সাড়ে তিনশত টাকা খরচ হয়। আমরা প্রতিকেজি ঝোল ও দানাগুড় ৪শত টাকা ও পাটালি এবং ক্রিম পাটালি পাঁচশত টাকা করে বিক্রি করছি। অনলাইনে নিলে ৬০০ ও ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়। বিদেশে রপ্তানি করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করছি। দেশের বিভিন্ন সুপার শপেও আমাদের গুড়ের স্যাম্পল পাঠিয়েছি। আগামী বর্ষার মৌসুমে আমরা আরও কয়েক হাজার খেজুরের চারা রোপণ করবো। ঝিনাইদহের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়ের জশ-খ্যাতি যেন হারিয়ে না যায় সেই লক্ষ্যে মান রক্ষা করে গুড় উৎপাদন ও বাজারজাত করে যাব। খেজুর গাছী সদর উপজেলার বাজার গোপালপুর (নওদাপাড়া) গ্রামের কবির হোসেন বলেন, আমার দেড়শ খেজুর গাছ আছে। আমি প্রতিদিন রাসেল গ্লোবাল লিমিটেডে রস দিই। 

আমরা শুধু যেদিন গাছ কাটি সেদিন অর্থাৎ জিড়েন রসই দিই। আমরা ২৫০ টাকা করে ১০ লিটার রস দিই। পরিছন্ন ভাবেই আমরা রস উৎপাদন করি। এদিকে, জেলা কৃষি বিভাগ খেজুর গাছ সংরক্ষণ ও নিরাপদ গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। গত ২৭ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১০০ জন গাছীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ঝিনাইদহ জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, ঝিনাইদহে বর্তমানে ১ লাখ ৪০ হাজারের মত খেজুর গাছ রয়েছে। আমরা খেজুর গাছের চারা রোপণে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। খেজুর গাছের চারা রোপণকারী ও নিরাপদ গুড় উৎপাদনকারীদের পুরষ্কারের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাকির হোসেন বলেন, খেজুরের গুড় ও রসের জন্য ঝিনাইদহ জেলার সুনাম সারা দেশে। নিরাপদ গুড়ের জন্য নিরাপদ রসের প্রয়োজন। খেজুর গাছের মিষ্টি রসের কারণে বিভিন্ন সময় দিনে-রাতে পাখ-পাকালি ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণির আনাগোনা থাকে। এসকল প্রাণির জীবাণু থেকে নিরাপদ রস ও গুড় উৎপাদন করতে উন্নত ও নিরাপদ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএইচ