বাংলাদেশের রাজনীতিতে রহস্যপুরুষ বলে অভিহিত করা হয় তাকে, তিনি সিরাজুল আলম খান। ষাটের দশকের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক স্বাধীনতার পরের বছরই আওয়ামী ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া বিরোধী দল জাসদের তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন তিনি, তাকে দাদাভাই বলে ডাকতেন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। উঁচুমানের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন, মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে রাষ্ট্র সংস্কারের ১৪ দফা প্রণয়ন করেছিলেন। ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে।
তার ৮৪তম জন্মবারর্ষিকী উপলক্ষে সোমবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরস্থ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘রাষ্ট্র সংস্কার ও সিরাজুল আলম খান দাদার ১৪ দফা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে সিরাজুল আলম খান (SAK) ফাউন্ডেশন ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
আলোচনায় সভায় বক্তারা বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও নিউক্লিয়াস প্রধান সিরাজুল আলম খানের রাষ্ট্র সংস্কার ভাবনা এখনও প্রাসঙ্গিক। সবার জন্য মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে সিরাজুল আলম খানের রাষ্ট্র সংস্কারে ১৪ দফা নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করতে হবে। এখান থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে প্রয়োজনীয় ভাবনা নিয়ে নতুনভাবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। ’৭১ এর স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্নের বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, তা এখনও পূরণ হয়নি। ২৪ এর জুলাই গণঅভুত্থান ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে বিতাড়িত করে নতুন সুযোগ নিয়ে এসেছে। একাত্তরকে ধারণ করেই সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
সিরাজুল আলম খান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জাসদ সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড.ওসমান ফারুক, অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুব্রত চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাবেক সচিব আবু আলম মো: শহীদ খান, মানবাধিকার কর্মী নূর খান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মাফুজুর রহমান, বাসদ সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ প্রমুখ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চাচনা করেন সিরাজুল আলম খান (এসএকে) ফাউন্ডেশন ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার ফারাহ খান।
আবু সাঈদ খান বলেন, ৬৬ সালে শেখ মুজিবের ছয় দফাকে স্বাধীনতার এক দফায় রূপান্তর করেন সিরাজুল আলম খান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার মুক্তিযুদ্ধকে এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক করতে গিয়ে অন্যদের অবদানকে স্বাকার করেনি। এখন সময় এসেছে এই জনপদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল নায়ককে তাদের প্রাপ্য সম্মান বুঝিয়ে দেওয়ার। সিরাজুল আলম খানের রাষ্ট্র সংস্কারে ১৪ দফার সঙ্গে অনেক বিষয়ে হয়ত অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। সব মতের মেলবন্ধনেই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে।
শরিফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, আমি সিরাজুল আলম ভাইকে রাস্তায়, মিছিলে, মিটিংয়ে, বাসায় সবখানে পেয়েছি। আমি তাঁর কর্মী ছিলাম। তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নিয়েছে। এখন জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের নায্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। তারা চিন্তাভাবনা সংশোধন করতে হবে। সামনের দিকে যেতে হলে ধর্ম বর্ণ গোত্র সবাইকে নিয়েই এগোতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, সিরাজুল আলম খান তাঁর অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁকে নিয়ে নানা জিজ্ঞাসা আছে, প্রশ্ন আছে, রহস্য আছে। কিন্তু আমরা যারা কাছ থেকে দেখেছি তিনি ছিলেন প্রাণখোলা মানুষ। তিনি ছিলেন নির্লোভ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি । রাষ্ট্র সংস্কারে তাঁর চিন্তাভাবনা এখন প্রাসঙ্গিক।
একসময়ের সহপাঠি ও বন্ধু সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক বলেন, ভিন্নমতের রাজনীতি করার পরও আমাদের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি গায়ের জোরে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতেন না। তিনি যেটা বিশ্বাস করতেন সেটা হৃদয় থেকেই করতেন।
ড. মাহফুজুর রহমান বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে স্বাধীনতার ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন।
বর্তমান সরকারের নানা ব্যর্থতা তুলে ধরে জেডআই খান পান্না অন্তর্বতী সরকারকে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান।
নতুন সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ে সুব্রত চৌধুরী বলেন, ৭২ এর সংবিধান ছুড়ে ফেললে আপনাদের স্বপ্নটাকেই আপনারা ছুড়ে ফেলছেন। একটা দেশ বার বার স্বাধীন হয় না। ৭১কে সঙ্গে নিয়েই সামনে এগোতে হবে।
সাইফুল হক বলেন, তিনি কর্মীবান্ধব মানুষ ছিলেন। তাঁর স্বপ্নে শত শত তরুণ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছে। তাঁর চিন্তাভাবনা এখনও প্রাসঙ্গিক এবং অনুকরণীয়।
বায়ান্ন/আরএইচ/এসবি